শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২০

আবির ভট্টাচার্য





জন্মান্তর




আজ বিজয়া দশমী। বসুবাড়ীর ঠাকুরদালানে চাঁদেরহাট। সুসজ্জিত

বৌমেয়েদের ভীড়,ছেলেবুড়ো সবাই ব্যস্ত।এবাড়ির কর্তামার নির্দেশে

সবকিছু চলে নিখুঁতছন্দে, সারা বাড়ি আনন্দে উজ্জ্বল। শঙ্খ-উলুধ্বনির

মধ্যে চলছে দেবীবরন, অপরাজিতার লতাবন্ধনে সুখের আলাপন,সিদ্ধির

শরবতে বিজয়া উদযাপন। এমন আনন্দের পরিবেশেও কি যেন এক গহন বিষন্নতা।বাড়ির একমাত্র বৌটি প্রায় বছরখানেক ধরেই অসুস্থ,আজ যেন বেশ বাড়াবাড়ি,ভালোয় ভালোয় বিসর্জনটুক মিটলে

হয়! কর্তামার নির্দেশে বৌরানীর ঘরে শেকল তোলা,সন্ধ্যায় কোলের

ছেলেটিকেও রেখে আসতে হয়েছে মায়ের কাছে, নাহলে সামলানো যাচ্ছিলো না।বড্ডাে বেশী যেন কাঁদছেআজ বাচ্চাটা, ভাবলো মধুর মা। জন্ম থেকেই ওর মা অসুস্থ, শিশুটির

দেখাশোনা করে ও। এমনিতে শান্ত, কিন্তু আজ যে কি হল;কি মনে

হতে দালান ছেড়ে ছেলেটার টানে বৌরানীর ঘরের দিকে চললো মধুর

মা;শেকল খুলে ঘরে ঢুকলো , বাচ্চাটা মায়ের বুকের ওপর আকুল হয়ে

কাঁদছে..আহা! হয়তো খিদে পেয়েছে, কোলে নিতে গেল... কিছুতেই ছাড়বে না মাকে, টানা হেঁচড়ার মাঝে হঠাৎ কামড়ে ধরলো  মায়ের পা..একি!

রক্ত বের হচ্ছে না কেন?বৌরানী সাড়াই বা দিচ্ছে না কেন? সামনে গিয়ে

চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,'বৌরানী:..বাইরে তখন মহা সমারোহে পুত্র

সৌভাগ্যদায়িনী মৃন্ময়ীর বরন চলছে, বড়ঘরের বৌটি একাকিনী গভীর

কোন অন্ধকারে চলে গেল..কেউ জানতেও না!

দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো, বাচ্চাটার জন্য না বৌরানীর জন্য

বুঝতে পারলো  না মধুর মা। পরক্ষনেই সম্বিত ফিরলো ,এ কি করছে সে?

কর্তামা বিসর্জনের আগে এঘরের শিকল খুলতে বারন করছিলেন, যদি

জানতে পারেন...গরীব ও। চাকরিটা ওর দরকার।'ক্ষমা কর বৌরানী'..,শিকল তুলে আবার

দালানে ফিরে গেল,মন পড়ে রইলো এঘরে।হায় রে নারীজন্ম!

পরদিন সকালে আবার দালানে লোকারন্য, কাল যেখানে দেবীবরন

চলেছিলো,আজ শোয়ানো এবাড়ির বৌরানীর সুসজ্জিত

মৃতদেহ, পাশে বসে সযত্নে সিঁদুর-চন্দন এঁকে দিচ্ছেন কর্তামা বধুমাতার।

কপালে..সবাই ধন্য ধন্য করছে বৌটির সৌভাগ্যে..'আহা'দশমীর শুভলগ্নে

স্বামীপত্র রেখে সগ্গে গেল গেলো ..'একসময়ে মায়ের পাশে এসে বসলেন

দুর্লভচন্দ্র।বৌটির স্বামী।'কখন হল এসব মা?' ঈষৎ স্খলিত স্বরে জানতে

চাইলেন..কাল সারা রাত বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন,মন লাগছিলাে না

আনন্দে,তবু স্বাভাবিক সৌজন্যে ছেড়ে আসতেও পারেননি...আর আজ

সকালেই শুনলেন...।

অল্পস্বল্প পড়াশােনা করেছেন তিনি । জানতেন সুচিকিৎসা হচ্ছে না তাঁর

স্ত্রীর, বলতে পারেন নি মাকে লজ্জায়, কিন্তু এত বড় অঘটন ঘটে যাবে,

ভাবতে পারেননি.. একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর ছ'বছর আগে বিয়ে করা

'সু'-এর দিকে...বড় সুন্দর হাসিখানি ছিলো সৌদামিনীর সবার আড়ালে আদর করে

ডাকতেন 'সু' ।'আর একটু সময় দিলে না আমায়.'...এসব ভাবতে ভাবতেই

পিঠে মায়ের হাত,'সময় হয়ে গিয়েছে'.. উঠে চলে গেলেন, পুরুষের কান্না

বারন; ভীষন শূন্যবোধ করছেন তিনি..

কাল সন্ধ্যায় যেপথে মৃন্ময়ীর বিসর্জন-শোভাযাত্রা গিয়েছে, আজ সেপথেই

চিরকালের জন্য এ ঘর ছেড়ে চলে গেল বিশবছরের মেয়েটি,ফেলে গেল তার হাসি,

বড়লোক শ্বশুরবাড়ির অতুল বৈভব,পাঁচবছর আর একবছরের দুটি

শিশুপুত্র, স্বামী...।

এই প্রথম বৌমার জন্য মনটা কেমন করে উঠলো কড়ামনের

কর্তামায়েরও.... আহা! খুব নিরীহ ছিলো মেয়েটা... কিন্তু এসব

দুঃখবিলাসের অবসর তাঁর নেই,ছেলের রকমসকম একেবারেই ভালো 

লাগছে না তাঁর, বৌমা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন বিবাগী হয়ে উঠেছে ছেলে;এতবড়ো সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী:ওকে আবার বাঁধতেই হবে সংসারের মায়ায়

খবর পাঠালেন গুরুদেবকে, এই দুঃসময়ে তাঁর সুপরামর্শ প্রয়ােজন।সেই

কবে বাইশবছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন,তারপর থেকে এই মানুষটির

সহায়তায় রক্ষা করেছেন শ্বশুরের সম্পত্তি, মানুষ করেছেন ছেলেকে। তিনি

জানেন সবাই তাঁকে ভয় পায়, কিন্তু রুক্ষ না হলে রক্ষা করতে পারতেন

এসব....

সন্ধ্যায় গুরুদেব এলেন;অনেকক্ষন পাঁজি দেখে বিধান

দিলেন,লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন বৌমার শ্রাদ্ধশান্তি হবে:এ মৃত্যু

অপঘাতই লক্ষ্মীপুজোর দিন গোধূলির শুভলগ্নে কোন সুলক্ষণা কন্যার

সাথে বিবাহ দিয়ে, বরবৌ একসাথে কুললক্ষীর পুজায় বসতে হবে:নাহলে

আবার একবছরের অপেক্ষা..কিন্তু এতদিন অপেক্ষা কর্তামায়ের পছন্দ

নয়,ছেলের মতিগতি ভালো  ঠেকছে না তাঁর তিনি কর্তামা; সংসার

বাঁচাতে হবে তাঁকে।ওসব মন নিয়ে ভাবনার দায় তাঁর নেই..

গুরুদেবকে যথাবিহিত বিদায় দিয়ে ডেকে পাঠালেন ছেলেকে জানালেন

সব কথা,তাঁর সিদ্ধান্তও। ক্ষণিকের স্তব্ধতা, ছেলে দৃঢ় কিন্তু মৃদুকণ্ঠে

জানালো ...'যদি আজ ও না হয়ে আমি হতাম,একই সিদ্ধান্ত হ্ত

তোমাদের..'কি বলছিস?'চমকে উঠলেন মা!...'তুমি তো পেরেছ মা!,

আমিও পারব। ভরসা রাখো!'এক অপার্থিব দৃঢ়তায় কথাগুলি বলে

বেরিয়ে গিয়েছিল দুর্লভ....তারপর থেকে বহুবার বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু

সেই অনমনীয় দৃঢ়তার কাছে হার মেনেছেন,সব দায়িত্ব যদিও তারপর থেকে ও একা সামলেছে।

সে সব প্রায় তিরিশবছর আগেকার কথা।আজও বিজয়া। এবার

মহালয়ার দিন জন্মেছে তাঁর ছোট নাতির মেয়ে, আজ বাড়ি আসছে

ওরা...আজ কেন কে জানে ভীষন মনে পড়ছে সেই অভাগিনীর

কথা....ওরই তো সব... নীচে শঙ্খধ্বনি হচ্ছে, ওরা কি ভুলে গেছে ওনার কথা?বেশ কিছুদিন বয়সজনিত কারণে শয্যাশায়ী তিনি। হয়তো এই আনন্দ মুহূর্তে তাঁর কথা মনে নেই....উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে, হঠাৎ

সম্বিত ফিরলো  'মা'-ডাকে... দুর্লভ দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে ,কোলে

নবজাতিকা, শুইয়ে দিলো  তাঁর পায়ের কাছে.... বৃদ্ধা অবাক হয়ে

দেখলেন...সেই ঘনপল্লবছায়াময় চোখ, সেই হাসি...এতছোট  বাচ্চা এমন

তাকায়,হাসে...একি! তিনি ঠিক দেখছেন তো! বাচ্চাটার পায়ে একটা

কালো  দাগ! যেমনটি ছিলো বৌমার মৃতদেহে,নাতির কামড়ের...'বৌমা!...

অনেক, অনেকদিন পরে কর্তামার চোখে জল দেখলো  সবাই...'ফিরে

এলি মা!.... আকুল হয়ে জড়িয়ে ধরলেন শিশুটিকে; মনে মনে বললেন,

''জন্মান্তর আছে কিনা জানিনে, ভালোবাসার বুঝি মরন হয় না....সে ফিরে ফিরে আসে....আসেই।''

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...