বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

অক্ষর কথা

 

 

 

অক্ষর কথা






 

ভালো আছেন বন্ধুজন! ভালো আছে আপনার চারপাশ, প্রকৃতি, রক্তের এবং না-রক্তের সম্পর্কের আপনজনেরা!

 

সদ্য রোগমুক্তির আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটছে আমাদের গোলোক। দীর্ঘ দু বছরের বেশি কত অসুস্থতার খানাখন্দে পা পড়ে গিয়েছিল আমাদের প্রায় অধিকাংশের। কত মৃত্যু ছুঁয়ে চলে গেল একের পর এক। মৃত্যু মিছিল। তবুও ওই যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, "মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি…"। কতখানি আত্মবিশ্বাস থাকলে এই শব্দসকল দৃঢ় উচ্চারণের সঙ্গে বলা যায়। আর সত্যিই তো, আমরা এটা প্রমাণ করে দিলাম যে মানুষ যদি লক্ষ্যে স্থির থাকে তাহলে তাকে সাময়িকভাবে কাবু করা যায় মাত্র, কিন্তু মেরে ফেলা যায় না।

 

অনেকদিন বৃষ্টির পরে রোদ্দুর উঠলে আকাশ হা হা করে হেসে ওঠে। ছলবল খলবল করে হাসতে হাসতে রাস্তায় নেমে আসে দুরন্ত প্রজন্ম। মুখের ক্লিষ্ট ছায়া, শরীরের সকল দৌর্বল্য অগ্রাহ্য করে খোলা হাত ছুঁড়ে দিয়ে আনন্দ মহরতে সামিল হয় অদম্য মানুষ। মানুষই পারে সব প্রতিবন্ধকতা জয় করতে তা বহুযুগ ধরে বারবার প্রমাণিত।

 

২০১৯ এর শেষ থেকে ২০২২ এর সম্মুখভাগ পর্যন্ত বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কত পরিবার, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ছোট দোকানী, ছোট কারখানার কর্মঠ তার সঠিক হিসাব পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু পিছনের দিকে না তাকিয়ে নতুন করে শুরু করেছে কতিপয় মুষ্টিবদ্ধ হাত। আর সেই সম্মিলিত হাতের জোর বাধ্য করেছে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাজকে তার অনুগত করতে।

 

আগে অনেকে হাহুতাশ করতেন, এখনো করেন আজকাল মানুষ নাকি বই পড়ে না, ছাপার অক্ষরের থেকে মোবাইলের যান্ত্রিক ছবির প্রতি আকর্ষণ এতটাই বেশি যে বইসাম্রাজ্য ধ্বংস হতে চলেছে! কত হতাশা, কত কষ্ট শব্দ হয়ে বেরিয়ে এসেছে, স্মৃতি বিধুর হয়ে উচ্চারিত হয়েছে শৈশব, কৈশোর, যৌবনের উদ্দীপ্ত ছাপার অক্ষরের দাপিয়ে বেড়ানোর রুদ্র গল্প। মনে হচ্ছিল মুদ্রিত বই, পত্রপত্রিকার দিন বোধহয় সত্যিই শেষ হয়ে গেল। আর তখনই সব অন্ধকার নিরাশাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে এসে গেল রোগমুক্তির ডংকা দু হাজার বাইশের বইমেলা।

 

এক‌টি বহুল প্রচারিত সর্বভারতীয় সংবাদপত্র টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর দেখুন - "The 45th International Kolkata Book Fair — one of the city’s most-loved annual events that had been stalled for two years due to the pandemic — ended on a celebratory note at Central Park with the footfall crossing 1.5 lakh on Sunday. While roughly 18 lakh visited the fair this time, books worth Rs 20 crore were sold at the two-week event — substantially higher than that of the last fair, held in 2020." অর্থাৎ মুদ্রিত বইয়ের ইতিহাসে ছাপিয়ে গেছে বই বিক্রির সব হিসাব, অতিক্রম করেছে রেকর্ড। বহু নতুন প্রকাশন সংস্থা এসেছে, এসেছে অনেক নতুন পত্রিকার রঙদার প্রচ্ছদ। এ তো শুধুই আশার আলো নয়, এ তো উজ্জ্বল রোদ্দুরের ঝলক!

 

আর এই আশা থেকেই আমরা এগিয়ে চলেছি, চলবে আগামীর মানুষ, আগামীর ছাপার অক্ষরেরা। অক্ষর বৃত্তের পক্ষ থেকে অফুরান শুভকামনা আমাদের সব ভাষাভাষী লেখক ও পাঠকদের। ভালো থাকুন, ভালো থাকুন এবং অনিবার্যতায় ভালো থাকুন সবাই অন্যদের হাতে হাত রেখে। জয় হোক মানুষের।



 

 

 



আলো বসু

 

 

 

 

 

 

একটি নিষিদ্ধ কবিতা



 

অনুভব করেছি, তাই বলছি /

অন্ধকারে থাকতে থাকতে আলোয় চোখ কুঁচকে/ যাবেই   /

গর্ভ থেকে বেরিয়ে কুঁকড়ে-মুকড়ে থাকে মাংসের/ দলাটি প্রথম আলোয় /

 পিটপিট চোখ ফোটে আর আলো /

চোখ খোলে আর নানাবিধ খুলে যায় আলো/

 

# সব চোখের কপালে আলো নেই, অন্ধকারই অব্যর্থ নিশানা/

 

 

# অনুভব করছি তাই বলছি /

এক একজনের চোখের আলোয়,কথার আগুনে/ চোখ রাখা যায় না /

এক একটা বইয়ের ডানায়  মিথ্যা স্বপ্ন/

স্বপ্নময় ইতিহাসের দরজা ঝলসে দেয় দুঃস্বপ্নের/ চোখ /

নির্বোধ বারুদের গায়ে পড়লে বুদ্ধের বাণী   /

দাউদাউ বুক /

ইতিহাস মুছে, ভুগোল ভেঙে মানচিত্রে আগুন/ লাগিয়ে দেবার মাতন লাগে /

 আধাখ্যাঁচড়া আলোর এই সভ্যতার বুক চিরে /

পথ যেতে চায় অন্য সূর্যের দেশে /

এইখানে,ঠিক এই সময় কোন নিষিদ্ধ নামের কথা/ আপনার মনে পড়লে জেনে রাখুন /আমার কোন নাম হয় না, দাম হয় না /

জাত ধর্ম কিচ্ছু নেই/

খিদে বিনিময় করি, ভাতের বদলে/

আমার মাথার ভেতরে বসে আমাকে চালিয়ে নিয়ে/ যান খরিদদার /

অনুভব করছি তাই বলছি, আলো দেখাবেন না /

একদিন আমি ঠিক অন্ধকার পৌঁছে দেবো ঘরে ঘরে /

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

রাখী নাথ কর্মকার

 

মা, তোমাকে



 

প্রিয় মাম,      

 

আজ এই প্রথম আমি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি।  নাহ, এর আগেও অবশ্য কোনোদিনই আমি তোমাকে কিছু লিখিনি।  না চিঠি, না চিরকুট। প্রয়োজনও পড়েনি!  কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, আমার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে তোমার জন্যে লিখে রেখে যাই কিছু অব্যক্ত স্বপ্নের উইল।  ইচ্ছে হচ্ছে, পুরোন বইএর তাকে থাকে থাকে চাপা পড়ে যাওয়া বিস্মৃত গল্পের মত আমার জমে থাকা ভারি কথাগুলোর চঞ্চল শব্দহীনতাটুকু অকপটে তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিই ! ঠিক তুমি যেমন ভাগ করে নিতে তোমার মিঠে আনন্দের আমেজটুকু - আমার সঙ্গে । ব্যালকনিতে সোনালী রোদ্দুরে ফুলভারে ঝুঁকে পড়া ঝলমলে সাদা গোলাপসুন্দরীর খুশীর মতন! তবে ছলছলে আষাঢ়ে মেঘরাশির মতো ভারী, তেতো দুঃখের ভাগটুকু কিন্তু তুমি আমায় কখনো দিতে চাওনি, আমি জোর করে চাইলেও না। অথচ দেখো, সেই তিতকুটে, আঠালো বিষাদটুকুই আজ ছড়িয়ে আছে আমার একঘেঁয়ে, একরঙ্গা দিনযাপনের যান্ত্রিকতার আনাচেকানাচে!                         

এখন গভীর রাত। খানিক আগেই বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। লাল হয়ে আছে শ্রাবণের আকাশ। তুমি জানো মাম, আমার খুব সাধ ছিল একখানি মেঘরঙ্গা উড়নির।  ঝলমলে রূপোলী চুমকিতারায় সাজানো। ঠিক যেমন এখন শ্রাবণ আকাশ তার আহত, অবাধ্য বুকের উথালপাতাল ঢেকে রেখেছে ঐ মেঘলা উড়নি দিয়ে। আকাশের দিকে না তাকিয়েই কিন্তু তুমি ঝিলিকতারার আকাশ খুঁজে পাবে মাম - ঐ উড়নির মাঝে ! আর খুঁজে পাবে চুমকিআয়নায় নিথর হয়ে যাওয়া মস্ত একখানি চাঁদ। তুমি কিন্তু আমার এই ইচ্ছে শুনে সেদিন বৈশাখের নিদাঘ রুদ্ররোষে আমার দিকে চেয়েছিলে!   

বড় সাধ ছিল আমার হলুদ অমলতাসের মত ঝিরঝিরিয়ে ঝুলে পড়া একজোড়া সোনালী ঝুমকোর - ঠিক যেমন ঝুমকোয় মিঠিদিদিকে তুমি সাজিয়ে দিয়েছিলে ওর বিয়ের সময়। তুমি তা জানতে পেরে সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলে আমার দিকে ।    

ইচ্ছে ছিল আমার, ইতিহাসের রহস্যময় অন্ধকার ছেনে তুলে আনব অজানা মণিমুক্তোর সম্ভার। তুমি ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলে-“তুমি ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনীয়ার হবে! মেয়েদের মত ইতিহাস নিয়ে টিচারি করবে শেষে?”   

মিঠিদিদির রংচটা, ভাঙাচোরা বার্বিগুলো, ওদের হলুদ ফুলছাপা স্কার্ট, ভ্যানিটি ব্যাগ - সব সব লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি আমার একাকী টেবিলের গোপন কোণায় পুরোন স্কুলব্যাগে। তোমার সাথে খেলতে চেয়েছি কতবার মিঠিদিদির ফুলো ফুলো ব্রাউনি টেডিটাকে নিয়ে। তুমি আর পাঁচটা ছেলের মতই আমার ঝুলি উপুড় করে দিয়েছিলে ট্রেন, বাস, বিল্ডিং ব্লকস, লেগো দিয়ে!    

 

আসলে আমার স্বপ্নটা ছিল বড়ই অদ্ভুত! অন্তত তোমার চোখে, তোমাদের সবার চোখে! আমার এই পুরুষালি শরীরের মিথ্যে খাঁচা থেকে মুক্ত করে এনে, পাঁপড়ি সরিয়ে দিয়ে জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি আমার চিরচেনা মেয়েলি প্রাণখানির সৌরভ!   

তুমি আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বলেছিলে-“এসব কি বলছ কী তুমি অরণ্য? তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান! এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে কী করে? এ নিশ্চয়ই তোমার ঐসব অনলাইন গেম খেলার ফল-রাতদিন কম্পিউটার নিয়ে পড়ে আছ! গেমের ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে এবার  রিয়েল দুনিয়ায় বেরিয়ে এস দেখি!”  

তুমি বোঝ না মাম, গেমের ঝকঝকে দুনিয়াটা কিন্তু ঐ ল্যাপটপএর ওপারেই ফেলে রেখে আসি আমি রোজ। সঙ্গে শুধু নিয়ে আসি এক ধূসর বিষণ্ণতা, ঠিক যেমনটি লুকিয়ে থাকে সন্ধ্যেশেষের জমাট অন্ধকারের মধ্যে। সেই বিষণ্ণতা বারে বারে আমায় মনে করিয়ে দেয় আমার সামনে অপেক্ষা করছে এক সুদীর্ঘ রাত। অস্থির, ছটপটে ঘুমও প্রায়ই স্বল্পায়ু হয়ে যায় যার কাছে ! ঘড়ির ক্লান্তিকর টিকটিকানির স্পন্দনে ভাবনাগুলো থিতিয়ে রেখে তারপর রোজ সকালে শুরু হয় আমার আর এক দীর্ঘ অপেক্ষা।     

মাম, তোমার মনে পড়ে - পাঁচ বছর বয়স থেকেই আমি তোমার কাছে আবদার করে এসেছি - ঝিরঝিরে গোলাপী লেস দেওয়া রুমাল; ফুল ফুল মোজা;  পরীর ডানাভাঁজে আটকে থাকা টুকটুকে পেনসিল ব্যাগ;  সোনালি চুলের বার্বি! তুমি বিহ্বল ঔদাসীন্যে আমায় এনে দিয়েছ স্পাইডারম্যান হ্যাঙ্কি; স্ট্রাইপড মোজা; বেন টেন পেনসিল ব্যাগ; দামী রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার। আমি যখন থার্টিন - তেরোর কুঁড়ির বাঁধন আলগা হয়ে আসতে শুরু করেছে, পরতে পরতে পাঁপড়ি খুলতে শুরু করেছে অমোঘ বসন্ত। তখন দ্বিধার আঁধার কাটিয়ে স্পষ্ট বুঝলাম আমি –আমি আর পাঁচটা ছেলের মতো নই, হতেও চাই না!     

 জানো মাম, তারপর কতগুলো একাকী রাত আমার বালিশ ভিজে চুপসি হয়ে গেছে, কতগুলো নিরালা দুপুর সাজানো বৃষ্টির অছিলায় ঝরঝরিয়ে কেঁদেছি আমি - যখন ঐ শব্দটার মানে জানতে পারলাম আমি! এক একসময় তো আমার মনে হত - শব্দটার মানে না বুঝতে পারলেই বোধহয় ভাল হত। এতোগুলো বছরের টানা সেই কনফিউশন, বিভ্রান্তির শেষে সেদিন যখন সঙ্গীহীন, বন্ধুহীন বিকেলে আমার আমিকে তোমার কাছে মেলে ধরেছিলাম, তুমি অন্ধকার চোখে চেয়ে বলেছিলে -“এ সব তোমার পাগলামি! তোমার মনের ভুল। এ হয় না, হতে পারে না।” তোমার নেগেটিভ নিঃশ্বাসে ঝলসে উঠেছিল তীব্র প্রত্যাখ্যান । তুমি আমায় স্বীকার করোনি। বোঝোনি, বুঝতে চাওনি। 

ভগবান তো শুনেছি কখনো ভুল করেন না, তাহলে কি আমিই ভুল?

আমি তো কখনোই, কোনোদিনই আর পুরোপুরি আরেকটি মিঠিদিদি হয়ে উঠতে পারব না মাম..!  সম্পূর্ণ অরণ্য ? তাও নয় !

 

আমার শরীরে মনে সারাক্ষণ বয়ে চলেছে অদ্ভুত এক চোরাটান। একটা অসম্পূর্ণতার বোধ যেন আমাকে জড়িয়ে থাকে সবসময়, শীতের ভোরের দুর্ভেদ্য ধোঁয়াশার মত। বাহ্যিক কোনো কিছুই এখন আর আলাদা করে প্রাধান্য পায় না আমার মনের মাঝে। ঐ সর্বগ্রাসী অস্তিত্বটুকু ছাড়া।     

 

আমার সমস্ত আবেগ জমাট বেঁধে এসেছে আজ হতাশ রাত্রির আনাচেকানাচে । গত কয়েক মাস ধরেই একটু একটু করে তিলে তিলে সরিয়েছি আমি, জমিয়েছি তোমার স্লিপিং পিলসের মুক্তোদানা। এবার হয়ত হঠাৎ খসে পড়া নামহীন সতেজ শিউলির মত দীর্ঘশ্বাস ফেলে একা একাই হারিয়ে যাব অভিযোগহীন বিস্মৃতির দুনিয়ায়। ভার্চুয়াল গেমের দুনিয়াটা কি এর চেয়েও মোহময়ী মাম?    

 

আজ, পৃথিবী আমার স্বপ্নের ওঠাপড়া নিয়ে কতখানি ভাঁজ ফেলবে তার কপালে, তা নিয়ে আমি এখন আর এতটুকু চিন্তিত নই । তবে, এটুকুই শুধু আমি বলে যেতে চাই, তোমার স্বীকৃতির চেয়ে বড় উপহার হয়ত আমার কাছে আর কিছুই ছিল না মাম! 

 

 

                                                                                                                                       ইতি, 

                                                                                                                            তোমার অরণ্য

                                                                                                                                            ১৩/১২/২১

 

অনিমেষ চন্দ্র

 

শব্দ



 

মনের অন্দরে বাঁধা আছে কত শব্দ,

একটু ভালোবাসার শব্দ,

কোনো কিছু ভালোলাগার শব্দ

কিছু মানুষের আবেগ প্রাণিত শব্দ।

কোনো ভালো শব্দ,

আবার কোনো খারাপ শব্দ,

আছে কিছু মাধুর্যপূর্ণ শব্দ।

খোলা হাওয়াই মন মাতানো শব্দ,

বিকেল বেলায় পরিযায়ী পাখিদের

দল বেঁধে ওড়ার শব্দ।

মানুষের কোলাহলে কান ফাটানো শব্দ,

রাস্তার জনজাটের শব্দ।

আবার কোথাও যানবাহনের শব্দ,

শহরে কলকারখানার শব্দ।

এই সবের আড়ালেও লুকিয়ে আছে,

কিছু হিংসার শব্দ কিছু অহংকারের শব্দ,

গর্বের শব্দ আবারো স্বল্প কিছু লেলিহান শিখার শব্দ তাছাড়াও লোভের শব্দ,

লালসার শব্দ,শাসকের অত্যাচারের শব্দ।

এই প্রকার শব্দগুলো কেউ কি শুনতে পায়?

জানি এই শব্দ সবাই শুনতে পায় তারপরেও,

কানে তুলো গুজে চোখে অন্ধ সেজে,

বসে থাকে আপামর জনতা,

প্রতিবাদের ভাষা জানাবার শব্দ আজ নেই।

নেই বিদ্রোহের শব্দ,নেই প্রতিবাদী শব্দ।

কেউ এই শব্দ বন্ধ করতে চায় না।

চায় এই শব্দ থেকে শুধুমাত্র নিজেকে রক্ষা করতে।

আর খুনো-খুনি দাঙ্গা ও রক্ত গড়ানো শব্দ গুলোকে এক একটি শাসক দলের উপর ঠেলে দিয়েই

নিজে নিজেকে চতুরতার পরিচয় দিতে চায়,

নিজের মনুষ্যত্বের বড়াই করতে চায়।

এটি থেকে বিরত নিতে হবে,

আমাদের মানব প্রজন্মকে।

প্রতিজ্ঞা করতে হবে সমস্ত মানবজাতিকে,

বলতে হবে এই মর্ত্যে হোক,

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কান ফাটানো,

চোখ ধাঁধানো প্রতিবাদী শব্দের জয়।

 

পঙ্কজ কুমার গাইন

অদৃশ্য সুতো
 



 
 
 
                      ১
 
 অন্ধ ---সাদা লাঠি হাতে নেমেছিল রাজপথে
আজ একা নয়---।
 
                    ২
 
কাকগুলো মাংস পিন্ড নিয়ে মাতামাতি
কুকুরগুলো যে ব্যস্ত, দখলদারিতে--- কামড়াকামড়ি।
 
                        ৩
 
অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা সব---
শহর নগর জীবন্ত শবদেহ নিয়ে কলরব। 

রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

ছেলেধরা

 



সেই কোন ছেলেবেলার ঢাউস ঝোলা, ভেতরে ছোট ছোট ছেলে ভরা, কালো দোহারা চেহারা, বিগত কয়েক জন্মের অগোছালো দাড়ি, উদোম গা, লুঙ্গি, যদিও ভূতপূর্ব হয়ে তা এখন ল্যাঙট হয়েছে

 

আচ্ছা, কুকুরগুলো এত চিৎকার করে কেন?

 

দোতলার চিলেকোঠা ঘর, আমার স্টুডিও, ছোট জানলা দিয়ে নিচে তাকাই, চোখে পড়ে উপচে পড়া ডাস্টবিন, বন্ধুদের নজরে আসে না, তারা আসে, হাসে, গপ্পো মারে, মদও, জানলা, তাকায়, সামনে বাড়ি, বৌদির স্লিভলেস নাইটি, দ্যাখে, খোঁজে, নতুন ছবি নামালাম কিনা, হতাশ হয়, খিস্তি মারে, টলমল পায়ে রবীন্দ্রকলি  ছড়িয়ে ফিরে যায়,

 

সাদা ক্যানভাসের মুখোমুখি বসি, কিংবা ক্যানভাস আমার মুখোমুখি বসে, বসেই থাকি, দুজন দুজনের দিকে চেয়ে, একটা লাইনও তাকে দিতে পারি না, জানলা, নিচে তাকাই, ডাস্টবিন, সে আসে, তার বাঁ হাতের লাঠি কতকিছু সরায়, তার পিঠের ঢাউস ঝোলায় ছোট ছোট ছেলেপুলে ভরা আছে,

 

নেড়ি কুকুরগুলো এত চিৎকার করে কেন?

 

ইজেলে লটকে আছে ক্যানভাস, অনাবৃষ্টির দিনযাপন, বুকের গভীর থেকে অনবরতই উঠে আসে কষ্ট, কষ্টের দলা, ছবি আসে না

 

ফিরছি, কলেজ স্ট্রিট থেকে, মাঝদুপুর, পাড়ার নেড়ি কুকুরগুলো খুব চিল্লাচ্ছে, এত কাছ থেকে এই প্রথম তাকে দেখলাম, একই চেহারা, একইরকম দৃশ্য, তবুও আরও কিছু দেখার জন্য পাশের একটা গ্যারেজের আড়ালে চলে এলাম

 

নিয়মানুযায়ী সে বাঁ হাতের লাঠি দিয়ে ডাস্টবিনের এটা ওটা নাড়াচাড়া করছে, মনেহল, আজ কিছুই জুটলো না, কয়েক সেকেন্ড, এদিক ওদিক চেয়ে একটু জোরে হেঁটে তুলে নিল একটা মুখোশ, মুখোশে জমা ময়লা হাত দিয়ে পরিস্কার করলো, সযত্নে, লাঠি ও ঝোলা নামিয়ে মুখের ওপর চাপিয়ে নিল সেই মুখোশ, এখন তার বাঁ হাত কোমড়ে , ডান তর্জনী টানটান করে প্রায় তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে যেন গোটা পাড়াটাকে সে আজ শাসন করছে, অথবা বুঝে নিতে চাইছে, এপাড়ায় আর কতগুলো ডাস্টবিন উপচে পড়ছে, কটা বেকার পুত্র বাপের ঘাড়ে চেপে আছে কোন কোন বাড়িতে ক'জন ছাঁটাই শ্রমিক রুগ্ন কারখানা বন্ধ মিল, কর্পোরেশনের জলের লাইন ঠিক কোথা দিয়ে যেতে পারে, প্রাইমারি স্কুল-এর খুব দরকার, ড্রেন দরকার? রাস্তা? একটা ভোটও যেন অন্যদিকে না যায়, দেখিয়ে দেব উন্নয়ন কাকে বলে

 

বাঁ হাতে তুলে নিল লাঠি, ডান হাত দিয়ে মস্ত ঝোলাটা ঝুলিয়ে নিল পিঠে, মুখোশটা মুখেই রইলো, রাক্ষসের মুখোশ, শান্ত,   ফিরে যাচ্ছে রাক্ষস, নাকি ছেলেধরা, ঝোলা ভরতি ছোট ছোট ছেলেপুলে, তাদের মগজ, চলে যাচ্ছে আমার ছেলেবেলার দিকে

 

স্টুডিওতে ফিরলাম, মুখোমুখি সাদা ক্যানভাস, প্যালেটে  উজাড় করে দিলাম কার্বন ব্ল্যাক-এর প্রায় পুরো টিউব, জানলা দিয়ে একবার নামলো চোখ, ডাস্টবিন

 

এ পাড়ার কুত্তার বাচ্চাগুলো শুধু চিৎকারই জানে

 

অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়

 

হে মহান কবি



 

ওদিকে মেঠো মানুষ ঘাম ঝরিয়ে

         ঘরে আনে সোনার ফসল।

বন্ধু তুমি কবিতা লেখো দৃষ্টি ফিরিয়ে আনমনে।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় দিনের পর দিন

ঘর সংসার ছেড়ে ওরা খোলা মাঠে আত্মাহুতি দেয়

ফসলের ন্যায্য মূল্য--আপন অস্তিত্ব বাঁচাতে;

শত যোজন দূরে সুদৃশ্য বৈঠকখানায় বসে

লিখে যাও কবি চাঁদ ফুল জ্যোৎস্নার

                 রঙিন প্রেমের কবিতা !

 

সীমান্তে বরফে ধসে রাইফেল হাতে বিনিদ্র রজনী

যে সৈন্য দেশ রক্ষা করে, বিসর্জন দেয় প্রাণ--

তোমার লেখনীতে তাদের জন্য থাকে না দীর্ঘশ্বাস।

সহস্র নিরন্ন মানুষ

     অগ্নি মূল্য বাজারে ছ্যাঁকা খেয়ে ঘরে ফেরে,

   তোমার কবিতায় কই সেই বিবর্ণ ছবি ?

 

তোমারই আশে পাশে অজস্র বেকার

           নিত্যদিন হতাশায় আত্মহত্যা করে;

সংসারের টানাটানি, অভাব মেটাতে বিক্রি করে দেয় শিশু।

হে মহান কবি,

       তোমার কবিতায় কেন নেই তাদের ঠাঁই ?

এমন ধূসর উদোম সমাজে তবে

        কার ঘানি টেনে যাও হে আধুনিক কবি ?

 

তোমার মাথার উপর

      চরম উদ্ধত যুগের উন্মাদ সভ্যতা

                        চন্ড নৃত্য করে।

তবুও তোমার কলমে ঝরে

                       রঙিন ফোয়ারা !

 

 

 

 

দীপঙ্কর বেরা

 

বাঁচব ভালোবেসে

 



 

 

 

 

বাঁচার স্বপ্নটা বেঁচে থাক যায় না যেন মরে

স্বপ্নের হাত ধরে সত্যিটা আসবে তবে ঘরে,

এই যে আমি এখন আছি তুমি আছ পাশে

আমরা চলি এগিয়ে লক্ষ্য পূরণ আশে।

 

 

বাঁচার জন্য লড়াই করা অনন্ত যুগ হাঁটা

পলি পড়া মাটির বুকে নতুন ফসল কাটা,

শীতের বেলা ঝরা পাতা সবুজ কিশলয়ে

ওই দেখা যায় নবীন আলো আনছে আবার বয়ে।

 

 

হাতটা ধরে হাতে হাতে আঁকড়ে ধরা বাঁচা

বিশ্বাসে সুখ দুঃখ মালা ভাঙছে মনের খাঁচা,

পরের জন্য বাঁচার হিসেব হৃদয় অঙ্গীকারে

স্বপ্ন রাঙা রঙিন মায়া নিজের অধিকারে।

 

 

পার্থিব সুখ অলীক মিছে ছুটছে বিষয় লোভ

আরও যেন অনির্বাণে পায় না কোন ভোগ,

স্বপ্নটা তাই বেঁচে থাকুক বাঁচার অবশেষে

অনন্ত যুগ তোমার জন্য বাঁচব ভালোবেসে।

 

  

প্রণতি গায়েন

'মুক্তির আকাশে  মৃণাল'

 


 

"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর

    অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর"।

-এই বিশ্ব সৃষ্টির মূল আধার হলো নারী ও পুরুষ।তাই এই বিশ্বচালনায় উভয়েরই প্রয়োজন।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা পুরুষ ও নারীকে সমান শক্তি বা সামর্থ্য যদিও দেননি, তবুও শৌর্য বীর্যে বুদ্ধিতে,স্নেহ-মায়া-মমতায় নারীর সামঞ্জস্য মেলা ভার।ঋগ্বেদে যে নারী ছিল 'গৃহিনী গৃহমূচ্যতে'বা 'সচিব সখী শিষ্যে ললিতে কলাবিধৌ'-সেই গৃহিনীই আবার স্মৃতিশাস্ত্রে হয়ে গেলেন'পূত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা'!

এখানে মনু লিখেছেন--'ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যে মর্হতি' অর্থাৎ দিনরাত নারীকে পুরুষের অধীন হতে হবে।ওদের সৃষ্টি কেবল পুত্র সৃষ্টির জন্য।তিনি তাঁর 'মনুসংহিতা'য়-'নারীবন্দনা' প্রসঙ্গে জানিয়েছেন-- ‌‌‌

"যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্ব্বাসূত্রাফল ক্রিয়া।"

অর্থাৎ তিনি নারীদের অনাদর না করে নারীরা পরিবারে সম্মানিত একথা বলেছেন।যেখানে নারীরা অসম্মানিত সেখানে যাজ্ঞযজ্ঞাদি সমস্ত ব্যর্থ ।নারী সম্মান পেলে দেবতারাও প্রসন্ন।মনুসংহিতা য় বিধৃত নারীর প্রাত্যহিক আচ‍রিত ধর্ম সম্পর্কে সচেতন রমনী একমাত্র তার প্রতি এরূপ সম্মাননা।তাঁর মতে বিবাহই একমাত্র নারীর বৈদিক উপনয়ন,পতিসেবা তার গুরুগৃহে

বাসের মতো।গৃহকর্ম সাঁঝ সকালের হোমযজ্ঞের সামিল।তবে তাদের সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার নেই, নেই বেদ পাঠের অধিকার।তাহলে শাস্ত্রজ্ঞানহীন,স্বাধীন অর্থকারী বৃত্তিহীন প্রথাগত শিক্ষাহীন নারীদের ধনসঞ্চয়ের অধিকার ও নেই।তাঁর মতে;--

"পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা পক্ষিতি যৌবনে

     রক্ষতি স্হবিরে পুত্রান স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য মর্হতি।"

এরা কুমারী অবস্হায় পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন।তাহলে নারী্র নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য কোথায়?পরাধীনতাই তার নিদান!আর এই পরাধীনতার বাঁধন যে,নারী মনে প্রাণে বরণ করে মানিয়ে নিতে পারবে -সেই পাবে তার প্রাপ্য পারিবারিক স্বীকৃতি।এখানেই নারীর অব্যক্ত যন্ত্রণা--"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার?" যেখানে নারী দ্বারা সৃষ্টি সচল ,সেখানে অধিকারের বেলায় কেন তাকে ছিনিয়ে নিতে হবে?কেন এত অত্যাচার, কেন এত বঞ্চনা-অবিচার?যেখানে বিশ্ব সুন্দর নারীদের নিয়ে ই,সেখানে কেন আকাশে বাতাসে এত নারীদের ক্রন্দন রোল ? কেন পুরুষ হবে বিধানদাতা,নিয়ন্ত্রা ও স্বেচ্ছাচারী?আর নারী কেন শুধু ভোগ্য বস্তু রূপে বিরাজিতা?

এইরকমই পরিবেশে সৃষ্ট রবীন্দ্রনাথের একটি নারী চরিত্র 'স্ত্রীর পত্র'-এ 'মৃণাল'।অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী প্রতিবাদী নারী বলেই যে সংসারী হতে পারেনি, কারণ নিয়ম না মানলেই এ সংসার তো তাকে নিমেষে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে।যদিও ডাস্টবিনে ফেলার আগেই আত্মসম্মান নিয়ে মুক্তির খোঁজে বেরিয়েছে মৃণাল।এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রতিবাদী নারীর মুক্তির গ়ল্প।

এই গল্পটি সবুজপত্রে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২১বঙ্গাব্দে।এই গল্পে সমস্তটাই পাঠকের সামনে এসছে মৃণালের পত্র রচনার মধ্যে দিয়ে।নারীর যে অস্তিত্ব দাসীর সমান বা তার ও কম বললেই চলে,যা একমাত্র মৃণালকে করেছে ক্ষতবিক্ষত।যে সমাজ নারীকে মর্যাদা না দিয়ে শুধু অবহেলা বঞ্চনা দেয়,সেই নির্দয় পুরুষ সমাজের দিকে প্রতিবাদের তর্জনী তুলেছে মৃণাল।রূঢ়,কর্কশ, নিষ্ঠুর সমাজের সঙ্গে প্রতিমুহুর্তে আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই করতে জানা এক প্রতিবাদী নারী-– মৃণাল।যে হয়ত সমাজে ব্যাধের মতো আক্রান্ত পিশাচদের হাত থেকে অসহায় বিন্দুকে বাঁচাতে পারেনি কিন্তু এই পুরুষ শাসিত সমাজকে ধিক্কার দিয়ে এক কাপড়ে

সাতাশ নম্বর মাখন বড়াললেনের পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের স্নিগ্ধ বাতাস নিতে পেরেছে।মুখ্যত এটি একটি পত্র,তাতে আদ্যপান্ত শুধু পরিবারের নীতিকথা,কিন্তু তিলতিল করে গড়া এক নারী্র হৃদয় কোমলতা- কঠোরতায় যা সংপৃক্ত ,তা আশ্রয় দিয়েছে এক সমপীড়িত ভিতু বালিকাকে।যে সমাজ নারী প্রগতির প্রতিরোধের

প্রাচীর ,তা ভেঙে মৃণাল এনেছে বিদ্রোহের ধ্বজা।সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে এটি একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী নারী চরিত্র।যা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের মাধ্যমে বাস্তবে এমন ই নারী চেয়েছিলেন।

গত পনোরো বছর বিবাহ হলে ও মৃণাল কোনোদিন স্বামীকে পত্র লেখেনি বা লেখার সুযোগ পায়নি।আজ তীর্থ করতে এসে স্বামীকে পত্র লিখছে। তবে এ চিঠি বাড়ির মেজবউসুলভ নয় - এ চিঠি এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর।যাকে পরিবারের প্রথম বউ-এর রূপ নেই বলে সূদূর  বাংলাদেশের পল্লী থেকে আনা হয়েছিল রূপে - গুনে অতুলনীয়া এই মৃণালকে। তবে বিধাতপুরুষ যেন একুট বেশিইরকম বুদ্ধি দিয়ে ফেলেছিলেন একে - যার খেসারত হিসেবে তাকে 'মেয়ে জ্যাঠা' বলে দুবেলা গালমন্দও খেতে হয়েছে। পরিবারের অজান্তে মৃণাল তার সমস্ত অভিব্যক্তি কবিতা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করত। সমাজের সবার প্রতি তার মায়া এমন কি গরু বাছুরের প্রতিও। ইশ্বর এক মেয়ে জন্ম দিয়েই কেড়ে নিলে ফলে এই দুঃখ ভুলতে সে গরু বাছুর নিয়েই মেতে উঠল। এই সময় বড় জায়ের বোন বিন্দু তার ভাইয়ের অত্যাচারে দিদির বাড়ি এলে মৃণাল ছাড়া বাকি সবাই তার প্রতি বিরক্ত এমনকি বড়জাও। বড়জার যদিও করার কিছু ছিল না - তার না ছিল রূপ, না ছিল গুণ। মৃণাল কিন্তু বিন্দুকে কাছে টেনে নিলে বড়জা বিপদ ডেকে আসা হল বলে এই ভাব দেখালেন। বিন্দু এল ভয়ে ভয়ে - তা দেখে মৃণালের দুঃখ হল। এমন কী  তার গায়ে লাল দাগ দেখে ঘামাচি ভাবলে তখন সবাই বললো এ বসন্ত। তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে মৃণাল তাকে আঁতুর ঘরে নিয়ে থাকতে চাইল। অবশেষে বিন্দুর দাগ মিলিয়ে গেল - আশ্রয়হীনাকে যমেও অরুচি কী না? এইসময় বিন্দু মৃণালকে বেশি করে আঁকড়ে ধরল। বিন্দুর প্রতি মৃণালের এই স্নেহ-ভালোবাসা বাড়ির সবার কাছে অসহ্য বাড়াবাড়ি মনে হলে, সবার রাগ এসে পড়ল বিন্দুর ওপর। স্বদেশী হাঙ্গামায় বিন্দুর হাত আছে মনে করা হলো। এই সময় মৃণাল আলাদা দাসী রাখলে তার স্বামী হাত খরচার টাকা বন্ধ করে দিল । মৃণাল খরচ কমাতে কোরাকলের ধুতি পড়তে লাগল এবং মতির মাকেও তার বাসন মাজতে নিষেধ করল। এদিকে বিন্দুর ব‌‌য়স বাড়লে জোর করে বিন্দুকে একটি পাগলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো। বিন্দু মৃণালের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললে যেদিন মৃণাল বিশ্বাস করলেও বাড়ির কেউ বিশ্বাস করলে না যে, বিন্দুর স্বামী পাগল। বিন্দুর ভাসুর জোর করে তাকে নিয়ে গেলে মৃণাল প্রতিবাদ করে; কিন্তু বিন্দু এই বাদ-প্রতিবাদে মৃণালের কথা ভেবেই ভাসুরের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়।

ইতিমধ্যে মৃণালের ভাই শরৎ কলকাতায় পড়তে এলে মৃণাল তাকে বিন্দুর খবরের জন্য নিয়োগ করল। শরৎ দুবার এফ.এ.ফেল করেছে শুধু সমাজসেবা করতে গিয়ে - পড়ার চেয়ে ভোলেন্টিয়ারি করা, প্লেগের পাড়ায় ইঁদুর মারা, বন্যায় ছোটদের - এসব তার কাজ ছিল। একদিন মৃণাল স্বামীর কাছে শুনল বিন্দু বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে আর তার জন্য তার ভাসুর খোঁজ করতে এসেছে । শরৎ খবর নিতে গিয়েছিল - যে সে তার ভাইয়ের বাড়িতে গেলে সেখান থেকে বিন্দুকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে খুরিমা শ্রীক্ষেত্র যাবেন বলে মৃণালের শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। মৃণালও জোর করে ধরল জেদ সেও যাবে। বুধবার যাওয়ার দিন, রবিবার সব ঠিকঠাক - মৃণাল শরৎকে দায়িত্ব দিয়েছিল - যেমন করে হোক বিন্দুকে খুঁজে পুরীর গাড়ীতে তুলে দিতে হবে। শরৎ ও সঙ্গে যেতে চায়। সেইদিনই শরৎ এসে খবর দিল আগের দিন রাত্তিতে বিন্দু কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরেছে। মৃণালের জন্য একটা চিঠিও রেখে গেছে - কিন্তু ওরা তা নষ্ট করেছে, বড়ো জা লুকিয়ে ঘরের ভিতর কাঁদলেন, আর নিজেকে সান্তনা দিলেন '-" সে মরেছে বইতো নয়, বেঁচে থাকলে কত কী হতে পারত।' দেশশুদ্ধ লোক মেয়েদের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরাকে একটা ফ্যাশন বললো।

মৃণাল তীর্থে এসেছে, বিন্দুর আর আসার প্রয়োজন হলো না। মৃণাল পতিদেবতাকে এ  পত্রে লিখছে - তাকে কোনো বদনাম নয়। লিখছে সেই সাতাশ নম্বর মাখন বড়াল গলিতে আর সে ফিরবে না। বিন্দুকে দেখে সে শিরায় শিরায় অনুভব করেছে এ সংসারে মেয়েমানুষের কী পরিচয় ? বিন্দুর মৃত্যু মৃণালকে আর বেড়ার মধ্যে থাকতে দিলো না। এই মেজো বউয়ের খোলস ছিন্ন করতে তাই তার এক নিমেষও সময় লাগেনি। আজ আর ওই গলিকে ভয় নেই। মাথার ওপর নীল আকাশ, স্বামীর ঘরের যে অভ্যাসের নাগপাশ তাকে অন্ধকারে ঘিরে রেখেছিল সে আজ তা ছিন্ন করে বাইরে এসে দেখল - গৌরব রাখার জায়গা নেই। মৃণাল মরতে যাচ্ছে তার স্বামী যেন একথা মনে না করেন। পুরোনো ঠাট্টা সে করবে না। মিরাবাঈ ও তো তার মতো মেয়ে ছিলেন। তাঁর শেকলও কম ভারী ছিল না। তাই তাঁর গানে বাপ ছাড়ুক, মা ছাড়ুক কিন্তু মীরার গানে লেগে রইল প্রভু। মৃণাল বাঁচবে ---

"সে তো কোনো সামান্য নারী নয় -

  নহি দেবী, নহি সামান্য নারী

পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে যে নহি নহি,

হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।

যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে,

সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে,

পাবে তবে তুমি চিনি‌‌তে মোরে"

এরকম ব্যক্তিত্বময়ী নারী তিনি, নিজের জীবনের কথা তাই স্বামীকে প‌ত্রে স্পষ্ট করে বোঝাতে যায়। গুরুত্ব বুঝতে পারলে তো মৃণালের উপযুক্ত স্বামীর অভাব হোত না? অবশ্য মৃণাল স্বামীর দোষ দেখেনি। তবে স্ত্রীকে ও যে স্বামীর উপযুক্ত হতে হবে - এ ধারনা মৃণাল ভেঙে দিয়েছে। তার কথায় ভঙ্গিতে বোঝা যায় স্বামীকেও স্ত্রীর উপযোগী হয়ে উঠতে হবে। এখানেই তো মুস্কিল। বিধাতা পুরুষ তো যতটা বুদ্ধি দরকার তার থেকে বেশি মৃণালকে দিয়েছেন।তাই তো গৃহমুখে বারবার ঘাত-প্রতিঘাত যা অন্য জায়ের ক্ষেত্রে ঘটেনি।আর এই উপস্থিত বুদ্ধিতে জাগিয়ে রাখতে সে নানা বাধা বিপত্তির মুখে পড়েছে।এখন ও নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, কখনও পরিবারের মানুষের শব্দভেদি বাণের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে মৃণালের বুদ্ধিদীপ্ত তেজ আরো শানিত হয়েছে।

দ্বিতীয় জবানবন্দি একটি ছোট পঙক্তিতে বিবৃত হয়েছে। গুরুত্বের দিক থেকে যা অসাধারণ। মৃণালের উদ্ধৃতি--- "আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জাননি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাশ যাই হোকনা, সেখানে তোমাদের অন্দর মহলের পাঁচিল ওঠেনি। সেইখানেই আমার মুক্তি, সেইখানেই আমি আমি। আমার মধ্যে যা কিছু তোমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে সে তোমরা পছন্দ করনি।চিনতেও পারনি, আমি যে কবি সে পনেরো বছরে ও তোমাদের কাছে ধরা পড়ে নি"। এই নীরব কবিত্ব - তাকে আলাদা এক অস্তিত্ব দিয়েছে।সুখ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা সব প্রকাশের একান্ত মাধ্যম এটাই। এ তার একান্ত অভ্যন্তরীণ শুধু তারই মনোজগত এটা। এর প্রকাশ নেই! এই পুরুষশাসিত সমাজের আধিক্য তার বুদ্ধিটাকে ভোঁতা করে দিয়েছে, সমাজের প্রচলিত রীতি যে - সে মানতে অপারগ। এমনকী গতানুগতিক জীবনস্রোতে চলতে বাধ‍্য হয়েছে।সন্তানটি হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই মৃণাল অন্যরকমভাবে নারী প্রগতি কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেষ্টা করেছে। বিন্দুর মতো নিরাশ্রয় মেয়েদের আশ্রয় দেওয়াও তার মধ্যে একটি। যদিও এর জন্য প্রচুর কটাক্ষ মৃণালকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তবু ও সমাজের পরিবারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে গিয়ে বিন্দুকে বাঁচাতে পারেনি - এখানেই তার ক্ষোভ। এক পাগলের সঙ্গে বিন্দুর বিয়ে হলো অথচ কেউ একথা বিশ্বাস করল না একমাত্র মৃণাল ছাড়া; তার দিদিও ভাগ্যের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে - 'কপালে দুঃখ থাকলে কেউ খন্ডাতে পারবেনা' বলে দিদি হয়ে কোনো বাঁচানোর চেষ্টা না করে শুধু ভাগ্যের দোহাই দিয়েই দায়িত্ব শেষ। অথচ মৃণাল তার ভাইকে নিয়োজিত করেও বিন্দুকে বাঁচাতে সক্ষম হলো না। মৃত্যু এসে সমস্ত প্রচেষ্টা মৃণালের ব্যর্থ করে তাকে হারিয়ে দিল। তবে এখান থেকে মৃণালের জ্ঞানচক্ষুর উন্মাচন !জীবনের মুক্তির পথ খোঁজা শুরু। এ মৃত্যু তার ভেতরের ঐশ্বরিক প্রতিবাদী শক্তিকে বের করে এনে এক নিমেষে সমস্ত কর্তব্য তুচ্ছ করে সাতাশ নম্বর মাখন বড়াল লেনের গলিকে অগ্রাহ্য করতে শেখাল। এখানেই এক নারীর প্রতিবাদে গল্পের সমাপ্তি। যে কথাগুলি একজন নারীর অন্তরের গভীরে গুমরে গুমরে মরছিল আজ তা পত্রাকারে বিস্ফোরিত হলো। সেই ব্যথিত অকথিত বাণী কলমের খোঁচাই হলো বাঙময়। এমনি এক নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থা মৃণালের মতো আমাদের অজস্র নারীকে বলি হতে হয়। যেখানে নির্দয় পুরুষরা মেয়েদের আজও ভোগ্যরূপে ভাবে, আজও নারীদের স্বাধীন ইচ্ছে নেই, আজও ছেলেরা বিয়ে করে আর নারীদের বিয়ে হয়।আজও নিরুপমারা, হৈমন্তীরা গোপনে কেঁদে আত্মবিসর্জন দেয়, আজও ভোরের জার্নাল খুলতেই বধূহত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, নারিপাচার, কন্যা ভ্রূণ হত্যা।আজও মেয়েদের নিজস্ব কোনও পরিচয় নেই। কে যেন বিদ্রুপ হেসে বলেছিল ----

"বাবার বাড়ি এই গেরামে, শ্বশুর বাড়ি ওই

তোমার বাড়ি কয় গো নারী, তোমার বাড়ি কই"

এই স্বতন্দ্র পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যই - মুক্তি পাওয়ার জন্যই মৃণালের এই পত্রলিখন। তার অভিপ্রায় নারীকে আপন অধিকার নিজেকেই অর্জন করতে হবে, এ সমাজ তাকে দেবে না। তাই আত্মবিসর্জন নয় একমাত্র মৃণালই দেখিয়েছে - এই সংসারের সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে মুক্তির পথ দেখে আপন স্বতন্ত্রতায় বাঁচা যায়। এরজন্য অফুরন্ত মননশক্তি  তো একা মৃণালের পক্ষে ভাঙা সম্ভব না - এর জন্য নারীদের নিজেদেরই অগ্রণী হয়ে সে দায়িত্ব নিতে হবে।যা মৃণালের ছিল সে একা এই অচলায়তন ভেঙে মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছে। আমরা মৃণালের এই পত্রের মাধ্যমে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পায় নির্দয় পুরুষ সমাজের কাছে নারীর সামান্য অধিকার দাবি করতে হয়, সে সমাজের কাছে এই প্রত্যাশাটুকু ছেড়ে দিয়ে প্রত্যেক মেয়েরই উচিৎ আপন জ্ঞানচক্ষুর আলোকে দেখে-নিজের পায়ে দাঁড়ানো। আর এই বিপ্লবীমনের পরিচয়ই পাই মৃণাল চরিত্রে। যে কিনা এই পত্র শেষে অচলায়তনকে ভেঙে তুলছে বিদ্রোহের ধ্বজা - যা প্রত্যেক মেয়েরই প্রেরণার উৎস প্রগতির গতি।তবে এখানে বলার মেয়েরা যদি নিজেদের অধিকার, সম্মান নিজেরা বুঝে নিতে সক্ষম না হয়,সচেতন না হয়,তবে অদূর ভবিষ্যতে তাদের পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে।তাই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁর মানস প্রতিবাদী নারীদের আমাদের সামনে এনে আমাদের চোখ খুলে দিতে চেয়েছেন।তিনি কিন্তু সমাজকে একটা নিরপেক্ষ প্রণ দিতে চেয়েছিলেন যে,নারীর স্বাধীনতার মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়,তার ভাবনাকে সম্মান করে,তার ভালো কাজে একটু নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা-,এগুলো ও কী একান্ত অভিপ্রেত নয়?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 'মুক্তির আকাশে  মৃণাল'

 

 

"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর

    অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর"।

-এই বিশ্ব সৃষ্টির মূল আধার হলো নারী ও পুরুষ।তাই এই বিশ্বচালনায় উভয়েরই প্রয়োজন।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা পুরুষ ও নারীকে সমান শক্তি বা সামর্থ্য যদিও দেননি, তবুও শৌর্য বীর্যে বুদ্ধিতে,স্নেহ-মায়া-মমতায় নারীর সামঞ্জস্য মেলা ভার।ঋগ্বেদে যে নারী ছিল 'গৃহিনী গৃহমূচ্যতে'বা 'সচিব সখী শিষ্যে ললিতে কলাবিধৌ'-সেই গৃহিনীই আবার স্মৃতিশাস্ত্রে হয়ে গেলেন'পূত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা'!

এখানে মনু লিখেছেন--'ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যে মর্হতি' অর্থাৎ দিনরাত নারীকে পুরুষের অধীন হতে হবে।ওদের সৃষ্টি কেবল পুত্র সৃষ্টির জন্য।তিনি তাঁর 'মনুসংহিতা'য়-'নারীবন্দনা' প্রসঙ্গে জানিয়েছেন-- ‌‌‌

"যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্ব্বাসূত্রাফল ক্রিয়া।"

অর্থাৎ তিনি নারীদের অনাদর না করে নারীরা পরিবারে সম্মানিত একথা বলেছেন।যেখানে নারীরা অসম্মানিত সেখানে যাজ্ঞযজ্ঞাদি সমস্ত ব্যর্থ ।নারী সম্মান পেলে দেবতারাও প্রসন্ন।মনুসংহিতা য় বিধৃত নারীর প্রাত্যহিক আচ‍রিত ধর্ম সম্পর্কে সচেতন রমনী একমাত্র তার প্রতি এরূপ সম্মাননা।তাঁর মতে বিবাহই একমাত্র নারীর বৈদিক উপনয়ন,পতিসেবা তার গুরুগৃহে

বাসের মতো।গৃহকর্ম সাঁঝ সকালের হোমযজ্ঞের সামিল।তবে তাদের সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার নেই, নেই বেদ পাঠের অধিকার।তাহলে শাস্ত্রজ্ঞানহীন,স্বাধীন অর্থকারী বৃত্তিহীন প্রথাগত শিক্ষাহীন নারীদের ধনসঞ্চয়ের অধিকার ও নেই।তাঁর মতে;--

"পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা পক্ষিতি যৌবনে

     রক্ষতি স্হবিরে পুত্রান স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য মর্হতি।"

এরা কুমারী অবস্হায় পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন।তাহলে নারী্র নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য কোথায়?পরাধীনতাই তার নিদান!আর এই পরাধীনতার বাঁধন যে,নারী মনে প্রাণে বরণ করে মানিয়ে নিতে পারবে -সেই পাবে তার প্রাপ্য পারিবারিক স্বীকৃতি।এখানেই নারীর অব্যক্ত যন্ত্রণা--"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার?" যেখানে নারী দ্বারা সৃষ্টি সচল ,সেখানে অধিকারের বেলায় কেন তাকে ছিনিয়ে নিতে হবে?কেন এত অত্যাচার, কেন এত বঞ্চনা-অবিচার?যেখানে বিশ্ব সুন্দর নারীদের নিয়ে ই,সেখানে কেন আকাশে বাতাসে এত নারীদের ক্রন্দন রোল ? কেন পুরুষ হবে বিধানদাতা,নিয়ন্ত্রা ও স্বেচ্ছাচারী?আর নারী কেন শুধু ভোগ্য বস্তু রূপে বিরাজিতা?

এইরকমই পরিবেশে সৃষ্ট রবীন্দ্রনাথের একটি নারী চরিত্র 'স্ত্রীর পত্র'-এ 'মৃণাল'।অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী প্রতিবাদী নারী বলেই যে সংসারী হতে পারেনি, কারণ নিয়ম না মানলেই এ সংসার তো তাকে নিমেষে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে।যদিও ডাস্টবিনে ফেলার আগেই আত্মসম্মান নিয়ে মুক্তির খোঁজে বেরিয়েছে মৃণাল।এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রতিবাদী নারীর মুক্তির গ়ল্প।

এই গল্পটি সবুজপত্রে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২১বঙ্গাব্দে।এই গল্পে সমস্তটাই পাঠকের সামনে এসছে মৃণালের পত্র রচনার মধ্যে দিয়ে।নারীর যে অস্তিত্ব দাসীর সমান বা তার ও কম বললেই চলে,যা একমাত্র মৃণালকে করেছে ক্ষতবিক্ষত।যে সমাজ নারীকে মর্যাদা না দিয়ে শুধু অবহেলা বঞ্চনা দেয়,সেই নির্দয় পুরুষ সমাজের দিকে প্রতিবাদের তর্জনী তুলেছে মৃণাল।রূঢ়,কর্কশ, নিষ্ঠুর সমাজের সঙ্গে প্রতিমুহুর্তে আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই করতে জানা এক প্রতিবাদী নারী-– মৃণাল।যে হয়ত সমাজে ব্যাধের মতো আক্রান্ত পিশাচদের হাত থেকে অসহায় বিন্দুকে বাঁচাতে পারেনি কিন্তু এই পুরুষ শাসিত সমাজকে ধিক্কার দিয়ে এক কাপড়ে

সাতাশ নম্বর মাখন বড়াললেনের পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের স্নিগ্ধ বাতাস নিতে পেরেছে।মুখ্যত এটি একটি পত্র,তাতে আদ্যপান্ত শুধু পরিবারের নীতিকথা,কিন্তু তিলতিল করে গড়া এক নারী্র হৃদয় কোমলতা- কঠোরতায় যা সংপৃক্ত ,তা আশ্রয় দিয়েছে এক সমপীড়িত ভিতু বালিকাকে।যে সমাজ নারী প্রগতির প্রতিরোধের

প্রাচীর ,তা ভেঙে মৃণাল এনেছে বিদ্রোহের ধ্বজা।সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে এটি একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী নারী চরিত্র।যা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের মাধ্যমে বাস্তবে এমন ই নারী চেয়েছিলেন।

গত পনোরো বছর বিবাহ হলে ও মৃণাল কোনোদিন স্বামীকে পত্র লেখেনি বা লেখার সুযোগ পায়নি।আজ তীর্থ করতে এসে স্বামীকে পত্র লিখছে। তবে এ চিঠি বাড়ির মেজবউসুলভ নয় - এ চিঠি এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর।যাকে পরিবারের প্রথম বউ-এর রূপ নেই বলে সূদূর  বাংলাদেশের পল্লী থেকে আনা হয়েছিল রূপে - গুনে অতুলনীয়া এই মৃণালকে। তবে বিধাতপুরুষ যেন একুট বেশিইরকম বুদ্ধি দিয়ে ফেলেছিলেন একে - যার খেসারত হিসেবে তাকে 'মেয়ে জ্যাঠা' বলে দুবেলা গালমন্দও খেতে হয়েছে। পরিবারের অজান্তে মৃণাল তার সমস্ত অভিব্যক্তি কবিতা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করত। সমাজের সবার প্রতি তার মায়া এমন কি গরু বাছুরের প্রতিও। ইশ্বর এক মেয়ে জন্ম দিয়েই কেড়ে নিলে ফলে এই দুঃখ ভুলতে সে গরু বাছুর নিয়েই মেতে উঠল। এই সময় বড় জায়ের বোন বিন্দু তার ভাইয়ের অত্যাচারে দিদির বাড়ি এলে মৃণাল ছাড়া বাকি সবাই তার প্রতি বিরক্ত এমনকি বড়জাও। বড়জার যদিও করার কিছু ছিল না - তার না ছিল রূপ, না ছিল গুণ। মৃণাল কিন্তু বিন্দুকে কাছে টেনে নিলে বড়জা বিপদ ডেকে আসা হল বলে এই ভাব দেখালেন। বিন্দু এল ভয়ে ভয়ে - তা দেখে মৃণালের দুঃখ হল। এমন কী  তার গায়ে লাল দাগ দেখে ঘামাচি ভাবলে তখন সবাই বললো এ বসন্ত। তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে মৃণাল তাকে আঁতুর ঘরে নিয়ে থাকতে চাইল। অবশেষে বিন্দুর দাগ মিলিয়ে গেল - আশ্রয়হীনাকে যমেও অরুচি কী না? এইসময় বিন্দু মৃণালকে বেশি করে আঁকড়ে ধরল। বিন্দুর প্রতি মৃণালের এই স্নেহ-ভালোবাসা বাড়ির সবার কাছে অসহ্য বাড়াবাড়ি মনে হলে, সবার রাগ এসে পড়ল বিন্দুর ওপর। স্বদেশী হাঙ্গামায় বিন্দুর হাত আছে মনে করা হলো। এই সময় মৃণাল আলাদা দাসী রাখলে তার স্বামী হাত খরচার টাকা বন্ধ করে দিল । মৃণাল খরচ কমাতে কোরাকলের ধুতি পড়তে লাগল এবং মতির মাকেও তার বাসন মাজতে নিষেধ করল। এদিকে বিন্দুর ব‌‌য়স বাড়লে জোর করে বিন্দুকে একটি পাগলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো। বিন্দু মৃণালের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললে যেদিন মৃণাল বিশ্বাস করলেও বাড়ির কেউ বিশ্বাস করলে না যে, বিন্দুর স্বামী পাগল। বিন্দুর ভাসুর জোর করে তাকে নিয়ে গেলে মৃণাল প্রতিবাদ করে; কিন্তু বিন্দু এই বাদ-প্রতিবাদে মৃণালের কথা ভেবেই ভাসুরের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়।

ইতিমধ্যে মৃণালের ভাই শরৎ কলকাতায় পড়তে এলে মৃণাল তাকে বিন্দুর খবরের জন্য নিয়োগ করল। শরৎ দুবার এফ.এ.ফেল করেছে শুধু সমাজসেবা করতে গিয়ে - পড়ার চেয়ে ভোলেন্টিয়ারি করা, প্লেগের পাড়ায় ইঁদুর মারা, বন্যায় ছোটদের - এসব তার কাজ ছিল। একদিন মৃণাল স্বামীর কাছে শুনল বিন্দু বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে আর তার জন্য তার ভাসুর খোঁজ করতে এসেছে । শরৎ খবর নিতে গিয়েছিল - যে সে তার ভাইয়ের বাড়িতে গেলে সেখান থেকে বিন্দুকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে খুরিমা শ্রীক্ষেত্র যাবেন বলে মৃণালের শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। মৃণালও জোর করে ধরল জেদ সেও যাবে। বুধবার যাওয়ার দিন, রবিবার সব ঠিকঠাক - মৃণাল শরৎকে দায়িত্ব দিয়েছিল - যেমন করে হোক বিন্দুকে খুঁজে পুরীর গাড়ীতে তুলে দিতে হবে। শরৎ ও সঙ্গে যেতে চায়। সেইদিনই শরৎ এসে খবর দিল আগের দিন রাত্তিতে বিন্দু কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরেছে। মৃণালের জন্য একটা চিঠিও রেখে গেছে - কিন্তু ওরা তা নষ্ট করেছে, বড়ো জা লুকিয়ে ঘরের ভিতর কাঁদলেন, আর নিজেকে সান্তনা দিলেন '-" সে মরেছে বইতো নয়, বেঁচে থাকলে কত কী হতে পারত।' দেশশুদ্ধ লোক মেয়েদের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরাকে একটা ফ্যাশন বললো।

মৃণাল তীর্থে এসেছে, বিন্দুর আর আসার প্রয়োজন হলো না। মৃণাল পতিদেবতাকে এ  পত্রে লিখছে - তাকে কোনো বদনাম নয়। লিখছে সেই সাতাশ নম্বর মাখন বড়াল গলিতে আর সে ফিরবে না। বিন্দুকে দেখে সে শিরায় শিরায় অনুভব করেছে এ সংসারে মেয়েমানুষের কী পরিচয় ? বিন্দুর মৃত্যু মৃণালকে আর বেড়ার মধ্যে থাকতে দিলো না। এই মেজো বউয়ের খোলস ছিন্ন করতে তাই তার এক নিমেষও সময় লাগেনি। আজ আর ওই গলিকে ভয় নেই। মাথার ওপর নীল আকাশ, স্বামীর ঘরের যে অভ্যাসের নাগপাশ তাকে অন্ধকারে ঘিরে রেখেছিল সে আজ তা ছিন্ন করে বাইরে এসে দেখল - গৌরব রাখার জায়গা নেই। মৃণাল মরতে যাচ্ছে তার স্বামী যেন একথা মনে না করেন। পুরোনো ঠাট্টা সে করবে না। মিরাবাঈ ও তো তার মতো মেয়ে ছিলেন। তাঁর শেকলও কম ভারী ছিল না। তাই তাঁর গানে বাপ ছাড়ুক, মা ছাড়ুক কিন্তু মীরার গানে লেগে রইল প্রভু। মৃণাল বাঁচবে ---

"সে তো কোনো সামান্য নারী নয় -

  নহি দেবী, নহি সামান্য নারী

পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে যে নহি নহি,

হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।

যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে,

সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে,

পাবে তবে তুমি চিনি‌‌তে মোরে"

এরকম ব্যক্তিত্বময়ী নারী তিনি, নিজের জীবনের কথা তাই স্বামীকে প‌ত্রে স্পষ্ট করে বোঝাতে যায়। গুরুত্ব বুঝতে পারলে তো মৃণালের উপযুক্ত স্বামীর অভাব হোত না? অবশ্য মৃণাল স্বামীর দোষ দেখেনি। তবে স্ত্রীকে ও যে স্বামীর উপযুক্ত হতে হবে - এ ধারনা মৃণাল ভেঙে দিয়েছে। তার কথায় ভঙ্গিতে বোঝা যায় স্বামীকেও স্ত্রীর উপযোগী হয়ে উঠতে হবে। এখানেই তো মুস্কিল। বিধাতা পুরুষ তো যতটা বুদ্ধি দরকার তার থেকে বেশি মৃণালকে দিয়েছেন।তাই তো গৃহমুখে বারবার ঘাত-প্রতিঘাত যা অন্য জায়ের ক্ষেত্রে ঘটেনি।আর এই উপস্থিত বুদ্ধিতে জাগিয়ে রাখতে সে নানা বাধা বিপত্তির মুখে পড়েছে।এখন ও নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, কখনও পরিবারের মানুষের শব্দভেদি বাণের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে মৃণালের বুদ্ধিদীপ্ত তেজ আরো শানিত হয়েছে।

দ্বিতীয় জবানবন্দি একটি ছোট পঙক্তিতে বিবৃত হয়েছে। গুরুত্বের দিক থেকে যা অসাধারণ। মৃণালের উদ্ধৃতি--- "আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জাননি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাশ যাই হোকনা, সেখানে তোমাদের অন্দর মহলের পাঁচিল ওঠেনি। সেইখানেই আমার মুক্তি, সেইখানেই আমি আমি। আমার মধ্যে যা কিছু তোমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে সে তোমরা পছন্দ করনি।চিনতেও পারনি, আমি যে কবি সে পনেরো বছরে ও তোমাদের কাছে ধরা পড়ে নি"। এই নীরব কবিত্ব - তাকে আলাদা এক অস্তিত্ব দিয়েছে।সুখ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা সব প্রকাশের একান্ত মাধ্যম এটাই। এ তার একান্ত অভ্যন্তরীণ শুধু তারই মনোজগত এটা। এর প্রকাশ নেই! এই পুরুষশাসিত সমাজের আধিক্য তার বুদ্ধিটাকে ভোঁতা করে দিয়েছে, সমাজের প্রচলিত রীতি যে - সে মানতে অপারগ। এমনকী গতানুগতিক জীবনস্রোতে চলতে বাধ‍্য হয়েছে।সন্তানটি হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই মৃণাল অন্যরকমভাবে নারী প্রগতি কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেষ্টা করেছে। বিন্দুর মতো নিরাশ্রয় মেয়েদের আশ্রয় দেওয়াও তার মধ্যে একটি। যদিও এর জন্য প্রচুর কটাক্ষ মৃণালকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তবু ও সমাজের পরিবারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে গিয়ে বিন্দুকে বাঁচাতে পারেনি - এখানেই তার ক্ষোভ। এক পাগলের সঙ্গে বিন্দুর বিয়ে হলো অথচ কেউ একথা বিশ্বাস করল না একমাত্র মৃণাল ছাড়া; তার দিদিও ভাগ্যের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে - 'কপালে দুঃখ থাকলে কেউ খন্ডাতে পারবেনা' বলে দিদি হয়ে কোনো বাঁচানোর চেষ্টা না করে শুধু ভাগ্যের দোহাই দিয়েই দায়িত্ব শেষ। অথচ মৃণাল তার ভাইকে নিয়োজিত করেও বিন্দুকে বাঁচাতে সক্ষম হলো না। মৃত্যু এসে সমস্ত প্রচেষ্টা মৃণালের ব্যর্থ করে তাকে হারিয়ে দিল। তবে এখান থেকে মৃণালের জ্ঞানচক্ষুর উন্মাচন !জীবনের মুক্তির পথ খোঁজা শুরু। এ মৃত্যু তার ভেতরের ঐশ্বরিক প্রতিবাদী শক্তিকে বের করে এনে এক নিমেষে সমস্ত কর্তব্য তুচ্ছ করে সাতাশ নম্বর মাখন বড়াল লেনের গলিকে অগ্রাহ্য করতে শেখাল। এখানেই এক নারীর প্রতিবাদে গল্পের সমাপ্তি। যে কথাগুলি একজন নারীর অন্তরের গভীরে গুমরে গুমরে মরছিল আজ তা পত্রাকারে বিস্ফোরিত হলো। সেই ব্যথিত অকথিত বাণী কলমের খোঁচাই হলো বাঙময়। এমনি এক নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থা মৃণালের মতো আমাদের অজস্র নারীকে বলি হতে হয়। যেখানে নির্দয় পুরুষরা মেয়েদের আজও ভোগ্যরূপে ভাবে, আজও নারীদের স্বাধীন ইচ্ছে নেই, আজও ছেলেরা বিয়ে করে আর নারীদের বিয়ে হয়।আজও নিরুপমারা, হৈমন্তীরা গোপনে কেঁদে আত্মবিসর্জন দেয়, আজও ভোরের জার্নাল খুলতেই বধূহত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, নারিপাচার, কন্যা ভ্রূণ হত্যা।আজও মেয়েদের নিজস্ব কোনও পরিচয় নেই। কে যেন বিদ্রুপ হেসে বলেছিল ----

"বাবার বাড়ি এই গেরামে, শ্বশুর বাড়ি ওই

তোমার বাড়ি কয় গো নারী, তোমার বাড়ি কই"

এই স্বতন্দ্র পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যই - মুক্তি পাওয়ার জন্যই মৃণালের এই পত্রলিখন। তার অভিপ্রায় নারীকে আপন অধিকার নিজেকেই অর্জন করতে হবে, এ সমাজ তাকে দেবে না। তাই আত্মবিসর্জন নয় একমাত্র মৃণালই দেখিয়েছে - এই সংসারের সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে মুক্তির পথ দেখে আপন স্বতন্ত্রতায় বাঁচা যায়। এরজন্য অফুরন্ত মননশক্তি  তো একা মৃণালের পক্ষে ভাঙা সম্ভব না - এর জন্য নারীদের নিজেদেরই অগ্রণী হয়ে সে দায়িত্ব নিতে হবে।যা মৃণালের ছিল সে একা এই অচলায়তন ভেঙে মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছে। আমরা মৃণালের এই পত্রের মাধ্যমে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পায় নির্দয় পুরুষ সমাজের কাছে নারীর সামান্য অধিকার দাবি করতে হয়, সে সমাজের কাছে এই প্রত্যাশাটুকু ছেড়ে দিয়ে প্রত্যেক মেয়েরই উচিৎ আপন জ্ঞানচক্ষুর আলোকে দেখে-নিজের পায়ে দাঁড়ানো। আর এই বিপ্লবীমনের পরিচয়ই পাই মৃণাল চরিত্রে। যে কিনা এই পত্র শেষে অচলায়তনকে ভেঙে তুলছে বিদ্রোহের ধ্বজা - যা প্রত্যেক মেয়েরই প্রেরণার উৎস প্রগতির গতি।তবে এখানে বলার মেয়েরা যদি নিজেদের অধিকার, সম্মান নিজেরা বুঝে নিতে সক্ষম না হয়,সচেতন না হয়,তবে অদূর ভবিষ্যতে তাদের পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে।তাই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁর মানস প্রতিবাদী নারীদের আমাদের সামনে এনে আমাদের চোখ খুলে দিতে চেয়েছেন।তিনি কিন্তু সমাজকে একটা নিরপেক্ষ প্রণ দিতে চেয়েছিলেন যে,নারীর স্বাধীনতার মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়,তার ভাবনাকে সম্মান করে,তার ভালো কাজে একটু নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা-,এগুলো ও কী একান্ত অভিপ্রেত নয়?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

  

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...