শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

দীপায়ন ভট্টাচার্য


ঐন্দ্রিলা, না অন্য কেউ ?



– উদিকে কুথায় যাচ্ছেন বাবু ? 

কথাটা শুনে থমকে গেলাম আমরা। ‘আমরা' মানে আমি, অর্পণ, দীপ্তিময় আর তার স্ত্রী ঐন্দ্রিলা। এসেছি এই ঝিকরগাছায় নিরিবিলিতে একটু বেড়াতে। যাকে বলে ‘পর্যটন কেন্দ্র’ ঝিকরগাছা তা নয়। এখানে চোখজুড়োনো পার্ক নেই, নদীতে প্রমোদতরী নেই, কারুকার্যময় রাজপ্রাসাদ বা পুরোনো মন্দির নেই, ঝাঁ-চকচকে হোটেল বা রেস্টুরেন্ট কিচ্ছু নেই। কিন্তু এতকিছু নেই বলেই আমরা এখানে এসেছি। ওই যাকে বলে ‘নির্জনতা’– আমরা এসেছি তার টানেই। আসলে ভিড়ে-ভিড়াক্কার জায়গাগুলোতে বছর বছর ঘুরে ঘুরে এবার আমরা এই নির্জন জনপদে দিন তিনেকের নির্ভেজাল গ্রীষ্মের অবকাশ কাটাতে এসেছি। আমরা তিনজন পুরুষই স্কুলশিক্ষক আর ঐন্দ্রিলা নিপাট গৃহবধূ। এখানে তেমন কিছু নেই বলে আড্ডার বিস্তর সময় ছিল । আমরা এখানে উঠেছি একজন পরিচিত অভিজাত বন্ধুর ফেলে-রাখা বাগানবাড়িতে। সেই বন্ধুটি কখনো-সখনো নাকি এখানে সদলবলে ‘হু- লা-ল্লা পার্টি করতে আসে। ‘হু লাল্লা পার্টি' মানে বড়লোকদের মস্তি – পঞ্চ ম-কারের স্রোত। আমরা ওই রাস্তায় হাঁটি না। তবে বাৎসরিক ভ্রমণের সুবাদে এই জায়গাটির বিবরণই আমাদের কাছে পছন্দসই মনে হয়েছিল। তাই সেই বন্ধুটির কাছে এখানে আসবার সব বন্দোবস্ত করেই আমরা এই ঝিকরগাছায় চলে এসেছি। কেয়ারটেকার নন্দলাল সপরিবারে এই বাড়িটাতেই থাকে। তারাই আমাদের খাওয়াদাওয়া, ফাই-ফরমাশ খাটার ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আমরা এখানে তাই এধার-ওধার ঘোরাফেরা, কখনো বিকেলের হাটে ছোট্ট টি স্টলে ঘন দুধের চা খাওয়া আর বিকেল-পেরোনো বেলায় নদীতীরে ঐন্দ্রিলার গান শোনার পাশাপাশি ওই বাড়িটারই বারান্দায় বসে প্রচুর গল্পগুজব আর পরনিন্দা-পরচর্চা করারও সুযোগ পেয়ে যাই।

 আমি এবার প্রশ্নকর্ত্রীকে খুঁটিয়ে দেখলাম। তবে না দেখলেও চলত। তার চেহারায় আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নেই। আদিবাসী রোগা মেয়ে, খড়ি ওঠা ত্বক – ধুলো-মলিন, চেহারার মতই জীর্ণ একটা শাড়ি পরণে, হাতে দুচারটে সস্তা কাচের চুড়ি, মাথায় খড়কুটোর বোঝা । তবে নজর করবার মত তার চোখদুটো। সেখানে প্রাচীন অন্ধকার যেন এই দিনের বেলাতেও ধকধক্ করে জ্বলছে। সে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে – যেন জবাব শুনতে চায়। বললাম – এই টিলার একদম ওপরে।

– উখানে নীল সাহেবের বঙ্গলা আছে।

 - নীল সাহেব! 

দীপ্তিময় কথাটার খেই ধরে নিয়ে বলল – আরে এই টিলাটার ওপর একটা নীলকুঠি আছে, নন্দলাল বলছিল । ও বোধহয় সেটার কথাই বলছে পরিতোষ দা । 

– নীলকুঠি! কই – এখান থেকে তো কোন বাড়ি-টাড়ি দেখা যাচ্ছে না। আমি বললাম।

মেয়েটি মুখে একটা বাঁকা হাসি টেনে নিয়ে বলল – সব -কিছু কি খালি চোখে দেখা যায়, বাবু সাহেব? 

ঐন্দ্রিলাও সমতুল হাসির ঝিলিক মুখে খেলিয়ে বলল – বাবা – এ দেখি ফিলজফিক্যাল থট মেশাচ্ছে কথায়। 

মেয়েটা গায়ে মাখল না কথাটা। একটু কেমন যেন ষড়যন্ত্রের স্বরে  মনকে সজাগ করে দিয়ে বলল – তবুও যদি উপরে উঠার শখ হয়, যাবেন। কিন্তুক বঙ্গলায় ঘুসবেন না।

– কেন ? নীলকুঠিতে ঢুকব না কেন? সাপখোপ আছে? এবার বলল অর্পণ।

– না না – উখানে ঝোপঝাড় নাই,পেঁচা-বাদুড়ের বাসা। সাপেরা সব লিচে নাইমে এসিছে । 

 – তাহলে তুমি আমাদের আটকাও কেন হে?

অধৈর্য অর্পণ বলে। 

– আটকাই না বাবু। আমি ডরাই, অন্দরে ঘুসলেই আপনাদের কেউ সাহেবের চেয়ারে গিয়ে বইসে পড়বেন। খৎরা তো সেইখানে। 

 – খৎরা – ধ্যুস্! চলো তো সব। এবারের বক্তা

ঐন্দ্রিলা । কণ্ঠস্বরেই বোঝা যায় ‘ মেয়েরা মেয়েদের সহ্য করতে পারে না ’। 

– সাহেব আমার ঘুমায়ে আছে। তারে জাগায়ে উপারের রাস্তায় পা বাড়ায়েন না মাঈজী। চোখের পাতাটুকুও না ফেলে একবার আমাদের সবার মুখের দিকে খরদৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটি তরতর করে টিলা থেকে নামার রাস্তায় রওয়ানা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই পথের বাঁকে হারিয়ে গেল।


স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলাম। অবিলম্বেই আমার হাত ধরে টান ঐন্দ্রিলার। সঙ্গে খিলখিল হাসি-সহযোগে কথা – কী পরিতোষ দা —এখানেই কি যাত্রা সাঙ্গ করবেন নাকি ? ওই নীলকুঠির রহস্য একটু ছুঁয়ে দেখবেন না?

দীপ্তিময় বলল – ওখানে না গেলেও তো চলে। অর্পণ বলল – ওটাই তো এখানকার একমাত্র  টুরিস্ট স্পট।

আমি বললাম – চলো চলো, দেখে আসা যাক । আবার ওপরে ওঠা শুরু হল । ওপরে উঠছি, কিন্তু এতটাই সহজ চড়াই যে একটুও হাঁপ ধরছে না। এই টিলার সবখানেই শুকনো শুকনো ছোট্ট মাপের ঘাস। কোথাও কোথাও একলা-দোকলা এক-দুটি গাছ পথচারীকে করুণ-চোখে তাকিয়ে  দেখে। ওই আদিবাসী মেয়েটা কি এদের কোন-কোনটাকে আরো কিছুটা ডালপালাহীন করে দিয়ে গেল? 

হঠাৎ অনুভব করলাম ঐন্দ্রিলার হাত আমাকে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য করছে। এক সময় নিচু গলায় সে বলল– আপনার সাথে আমারও তো বিয়ে হতে পারত পরিতোষদা।

ঐন্দ্রিলা! আমি আরো পিছিয়ে গেলাম – সময়ের দিক থেকে। বছর বারো আগে ঐন্দ্রিলারা তো আমাদের পাড়াতেই ভাড়া এসেছিল । আমি তখন স্কুল-শিক্ষকতার চাকরিতে সদ্য জয়েন করেছি। ঐন্দ্রিলা তখন পড়ত সেই স্কুলটারই পাশের কলেজে। কখনো বাসে যেতে-আসতে দেখা হয়েছে, পরিচয় হয়েছে, বাসে পাশাপাশি বসলে কথাও হয়েছে অল্পবিস্তর। আমার মনে তখন বিশেষ কোন অনুভূতি জাগে নি। কে জানে ওর জেগেছিল কি না! পাড়ার অনুষ্ঠান-বাড়িতেও তো কালে-ভদ্রে দেখা হয়ে বাক্যালাপ হয়েছে। কিন্তু কই, সেখানে কারো তরফ থেকে কোন বিশেষ ইচ্ছে প্রকাশ পায় নি তো! তারপর তো ঐন্দ্রিলারা এই পাড়া ছেড়ে শহরের অন্য প্রান্তে ভাড়া চলে গিয়েছিল। অবরে-সবরে ঐন্দ্রিলা নাকি দু'একবার আমাদের বাড়িতে এসে গল্পগুজব করে গেছে। কিন্তু আমি তো তখন হয় স্কুলের কাজে, নয় ভিন্ পাড়ার ক্লাবের আড্ডায়। তবে হ্যাঁ, এরও পরবর্তীকালে ঐন্দ্রিলার বাবা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে ঐন্দ্রিলার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু ততদিনে অভিভাবকদের উদ্যোগে আমার পাকা-দেখা হয়ে বিয়ের দিন স্থির করাও শেষ। আমার দিক থেকে তার অন্যথা করার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু ঐন্দ্রিলা......! 

 আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে ধরালাম। 

– বাঃ, লাইটারটা তো চমৎকার। ঐন্দ্রিলা মুগ্ধকন্ঠে বলল। 

– এটা স্নিগ্ধা – মানে তোমার বৌদি প্রেজেন্ট করেছে এখানে আসবার আগে। ওর বাবার অসুস্থতার জন্যে ও তো এই প্রথম আমার সাথে বেড়ানোটা মিস্ করল।

  ঐন্দ্রিলার মুখে মেঘ নেমে এল। সে আমার হাত ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে মিলে গেল দীপ্তিময়দের সাথে।  আমি থমকে দাঁড়িয়ে ঐন্দ্রিলার প্রতিক্রিয়াটা খেয়াল করলাম। তারপর আবার হাঁটা দিয়ে ওদের চেয়ে একটু দেরিতে পৌঁছোলাম নীলকুঠি চত্বরে।


এই প্রাঙ্গন যেন পৃথিবীর শান্তি-স্নিগ্ধ দ্বীপ। চারধারে কোত্থাও কেউ নেই। গোটা টিলায় একমাত্র এখানটাতেই একসাথে গোটা কয়েক শাল গাছ আছে। কিন্তু আশ্চর্য – সেখানে একটাও পাখি নেই। আকাশে ঘোলাটে মেঘের রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছে। বৃষ্টিবিন্দু ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করল মাটিতে।

 অর্ণব বলল – ভেতরে চলুন । এখানে দাঁড়িয়ে ভিজব নাকি?

দীপ্তিময় বলল – কোনমতে ফিরে গেলে হত না? সঙ্গে  তো দুটো ছাতা আছে।

– আমি বাপু একটু না জিরিয়ে ভিজে ফিরতে পারব না। মাঝ রাতে আবার গাড়ি ধরতে হবে। ঐন্দ্রিলার অসম্মতির কথা। 

 হ্যাঁ – আজ রাত একটায় আমরা ফিরব। নীল সাহেবের বাংলোটার দিকে তাকালাম। জীর্ণ। জায়গায় জায়গায় ইঁটের হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে রয়েছে। এই চত্বরের কোথাও কিন্তু কোন ঝোপঝাড় নেই। কেউ যেন নিয়মিত এই জায়গাটা সাফ-সুতরো রাখে। বললাম – চলো সবাই ভেতরে চলো। এই বৃষ্টি এখুনি ধরে যাবে। ভেতরেই ঢুকে পড়লাম। ভেতরে একটা দরজা-জানালারও কোন পাল্লা নেই। একটাও আসবাবপত্র নেই। পেছনের জানালা দিয়ে দেখলাম একফালি জমি পেরিয়েই একটা গভীর খাদ। খাদের অনেক নিচ থেকে শুরু ধানখেত আর তারপরই রয়েছে বোধহয় একটা রাস্তা  আর জঙ্গল। এখান থেকে বোঝা যায় টিলাটা কত উঁচু। আচ্ছা – এটা নীলকুঠি যখন, আশপাশের গোটা এলাকায় কি নীলচাষ হত? জোর-জবরদস্তি করে?  আমরা সবাই তখন মেতে উঠলাম নীল যুগ থেকে নীলবিদ্রোহ পর্যন্ত বিষয় নিয়ে জাবর কাটতে ।  ততক্ষণে বৃষ্টি-পর্ব শেষ হয়ে গেছে । আকাশে আবার হাজির হল বিকেলের রোদ। আমরা নিচের রিক্ত ঘরদোর ঘুরে দেখে ওপরে ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে বাঁধা পেলাম। সিঁড়িটা ভেঙেচুরে গেছে।

 ঐন্দ্রিলা বলল – চলুন, এবাড়ির পেছনটায় একটু ঘুরেফিরে তারপর নিজেদের আস্তানায় ফিরে গিয়ে গোছগাছ  করি। রাত্রে তো আবার সফর আছে।

           বাড়ির পেছন দিকটায় একচিলতে ঘেসো জমির এক প্রান্তে পৌঁছে একটা পুরোনো পাকাপোক্ত কবর আবিষ্কার করা গেল। তার এপিটাফেও ভাঙনের থাবা। ইংরেজিতে 'ও'নীল' শব্দটা শুধু উদ্ধার করা গেল। দীপ্তিময় বলল – এতক্ষণে বোঝা গেল – পথের সেই মেয়েটি কেন এটাকে 'নীল সাহেবের বাংলো' বলেছিল।

ঐন্দ্রিলা বিরক্ত স্বরে বলল – আমি বলছি এটা নীলকুঠি, নীলকুঠি, নীলকুঠি। মেয়েটা আর কতটুকু জানে?

 দীপ্তিময় বিদ্রূপ-মেশানো কণ্ঠে বলল – হ্যাঁ তুমিই তো সবকিছু জেনে বসে আছ । 

ঐন্দ্রিলার রুষ্ট নজর ছুটে গেল দীপ্তিময়ের দিকে। তাঁর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোনোর আগেই অর্পণ বলে দিল – আমি জানতাম, এখানকার কোথাও কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবেই যাবে।

– কীসের চিহ্ন? এবারের কথাটা ঐন্দ্রিলার। 

  – মানুষের বসবাসের। 

– এটা তো একটা মানুষ ফুরিয়ে যাবার চিহ্ন। 

অর্পণ এবার অন্য প্রসঙ্গে গেল। বলল – আফ্রিকার এক আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে কীরকম দুশ্চিন্তা ছিল জানেন ? আমি বললাম – কীরকম?

– মৃত্যুর পর প্রেতাত্মা যায় মৃত্যুদেবতা ওয়ালুম্বের কাছে। সেখানে বলে তার জীবনবৃত্তান্ত। তারপর ফিরে আসে নিজের এই রকম কোন কবরে। সেই প্রেতের জীবিত ঘরণীরা তখনও তাকে খুশি রাখতে আপ্রাণ সেবা করে চলে। কবর তকতকে রাখে, মৃত স্বামীর গাছগাছালির পরিচর্যা করে। যদি এই সেবাকর্ম ঠিকঠাক না হয় তাহলে ওই স্বামীর প্রেতাত্মা রেগে গিয়ে এমন হত্যালীলা বা ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে যে শ্যামন বা ভূতের ওঝা নামিয়েও সে তান্ডব সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে।

– তার মানে আপনি বলছেন স্বামীর মৃত্যুর পরও স্ত্রীকে কোথাও সেবাদাসী হয়ে থাকতে হয়। তা সেটা কি খুব অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ? ঐন্দ্রিলাকে বলতে শোনা গেল।

– আমি কিছুই বলছি না, শুধু আপনার পেছনে একবার তাকিয়ে দেখুন।

ঐন্দ্রিলা চমকে পেছনে ঘুরে তাকাল। গোটা বাড়িটায়  এই একটাই দরজা দেখা গেল যেখানে পাল্লা, কপাট অক্ষত আছে এবং কপাটে শেকল তোলা।

– চলুন, এবার এই দরজা দিয়ে ঢুকে এখানটায় কোন রহস্য আছে কি না একটু খোঁজ নিয়ে যাই। অর্পণের প্রস্তাব।


 দীপ্তিময় আপত্তি করেছিল বটে, কিন্তু আজকের সফরে ফিনিশিং টাচ দেবার আমাদের সমবেত উৎসাহে ওর ক্ষীণ আপত্তি যেন ফুৎকারে উড়ে চলে গেল। 

আমরা  কপাটের শেকল খুলে নিচু হয়ে ওই ছোট্ট দরজা দিয়ে ঢুকলাম।  আমাদের সাথে শেষবেলার আলোও যেন অনেকদিন পর ওই ঘরে ঢোকার সুযোগ পেল। সেই আলোতেই দেখলাম, ছোট্ট, নিচু ওই ঘরে এখানে-ওখানে পড়ে রয়েছে সাপের পরিত্যক্ত খোলস। তার মানে, ওই আদিবাসী মেয়েটিও এই নীল সাহেবের বাংলোর সব রহস্য জানে না! 

যে ছোট্ট ঘরে আমরা  ঢুকে পড়েছিলাম, তারও একটা রহস্য বেরিয়ে পড়ল। সেই ঘরটা পেরোলেই একটা সঙ্কীর্ণ বারান্দা, দুধারে দেওয়াল।  সমস্ত বারান্দাতেও ইতস্তত ছড়ানো সাপের খোলস । বারান্দা  গিয়ে শেষ হয়েছে আবার একটা দরজাতে। অতিকষ্টে ‘ক্যাঁ....চ্’ করে আবার যখন সেই দরজাটাকেও খুলে ফেলা গেল, তখন আবার এক বিস্ময় — দরজা পেরিয়ে দু'চার পা এগোলেই পাতালযাত্রার অন্ধকার সিঁড়ি। আমাদের সবার মনে তখন যেন ঘোর লেগেছে। হাতে-হাতে মোবাইল-টর্চ জ্বলে গেল – আমরা নিচে নামতে লাগলাম। যখন পায়ের নিচে একটা প্রশস্ত মেঝে পেলাম, তখন দেখি সামনে আর বাঁ-পাশে দুটো করে লোহার গারদ; ডান পাশের দেওয়ালের গায়ে একটা ইট-গাঁথা হাতলওয়ালা চেয়ার। সেখানে বসে কেউ চারখানা গারদে নিখুঁতভাবে নজরদারি করতে পারে । আমরা যখন মোবাইলের আলোয় ওই

বিরাট ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছি, তখন অর্পণ হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে উঠল — গুমঘর ! 

হ্যাঁ, গুমঘরই তো। এটা যখন নীলকুঠি, তখন এই চারখানা গরাদ-খোপযুক্ত পাতালঘরটা গুমঘরই তো হবে। কত নীলচাষির দীর্ঘ নিশ্বাস গুমরে ফিরেছে এই দেওয়ালে দেওয়ালে, কারো শেষ নিশ্বাসও হয়তো বা। কিন্তু আমরা ওসব অতীত-কথা না ভাবলেও পারতাম। কারণ, আমাদের এই মুহূর্তেকের অন্যমনস্কতার সুযোগে অর্পণ গিয়ে বসে পড়েছে ওই হাতলওয়ালা চেয়ারে। 

– অ-র্প-ণ! আমার আর দীপ্তিময়ের কন্ঠ থেকে একটা আশঙ্কার আর্তনাদ ছিটকে এল। 

অর্পণের চোখ লাল হয়ে যেন ঠিকরে বেরিয়ে

আসছে। কপালে আর নাকের দু'পাশে জমতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাত, পা, শরীর কাঁপতে শুরু করল। মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল লালা। একটা কর্কশ, অপার্থিব স্বরে অর্পণ হুংকার দিল – কেন এসেছিস এখানে? মারবি আমাকে? মারবি?

দীপ্তিময় ব্যাকুল-কণ্ঠে বলল – এসব কী বলছ অর্পণ! আমরা মারতে পারি তোমাকে? এখানে আর নয়-চলো।

 দীপ্তিময় অর্পণকে হাত বাড়িয়ে টানতে যাচ্ছিল, ঐন্দ্রিলা পেছন থেকে তাকে জাপ্টে ধরে চিৎকার করে  বলল – কাকে এসব বলছ?  উনি আর অর্পণবাবু নেই, অন্য কেউ। শিগগির চলো – চলো! 

 এবার দীপ্তিময় কাঁপা কাঁপা স্বরেই একটা দৃঢ় কথা বলল –  যাই ঘটুক, অর্পণকে ফেলে আমরা চলে যেতে পারি না। 

 অর্পণ এবার হাহাকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল – আমাদের তোরা শান্তিতে বাঁচতে দিস নি। এবার সাপ তোদের একটাকে নেবে । আজ রাতেই । 

– সাপ– ওরে বাবা! ঐন্দ্রিলা সিঁড়ি ভেঙে উর্দ্ধশ্বাসে ওপরে উঠে গেল। ওপর থেকে শোনা যেতে লাগল ওর পরিবাহী চিৎকার। 

অৰ্পণ তখন হাঁপাচ্ছে। চেয়ারে বসে-বসেই কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে। আমরা দুজন উত্তেজনায় কাঁপছি। হঠাৎ দীপ্তিময় চিৎকার করে অর্পণের  দিকে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে মারল এক টান । অর্পণ হুমড়ি খেয়ে মেঝেয় পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আমরা দুজন কোনমতে সেই অজ্ঞান দেহটাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। একফালি সবুজ জমি, কবর, ঘর কোথাও না থেমে একেবারে গিয়ে নীলকুঠির বাইরের মাঠে থামলাম । অর্পণের মুখে-চোখে জল দিয়ে তাকে খাড়া করালাম। ঐন্দ্রিলা তখন না পারছে আমাদের ছেড়ে একা চলে যেতে, না পারছে এখানে স্থির হয়ে দাঁড়াতে। শেষ বিকেলের সূর্যটাও তখন পৃথিবী থেকে যেন পালাতে ব্যস্ত।  সেই অস্তরাগের আলোতে ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম – তার মালার লকেটে ধকধক্ করে জ্বলছে সাপের ফণা!  এ বিষয়ে আর কাউকে কিছু না বলে, 

প্রবল আতঙ্ক নিজের মনে চেপে দিয়ে কোনমতে আস্তানায় ফিরে নিজের ঘরে দরজা দিলাম। রাত এখনও বাকি। মাঝরাতে হাইওয়ে ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে বাস ধরতে যেতে হবে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে। সঙ্গে থাকবে...... ঐন্দ্রিলা — যার গলায় সাপের লকেট! আজ রাতে কার পালা ?  কার?


রাতে নন্দলাল এসেছিল খোঁজ নিতে। ও বলল – আপনারা নীল সাহেবের বাংলোতে যাবেন জানলে আমিই আটকে দিতাম।

– কে নীল সাহেব? বলতে গিয়ে আমার গলাটা কেঁপে উঠল। 

 – সে নাকি হুই বাংলোতে বহু-বহু বছর আগে একা-একা থাকত। এখানকার গাঁওবুড়োরা বলে। ওই সাহেব নাকি নীল চাষ করানোর জন্যে খুব অত্যাচার করত। আবার একজন আদিবাসী মেয়েকে নিয়ে খুব ফষ্টিনষ্টিও করত। এক রাতে এক দঙ্গল আদিবাসীর কাছে দু'জনে হাতেনাতে ধরা পড়ে। সাহেব মরে আদিবাসীদের হাতে মার খেয়ে আর মেয়েটি মরে খাদে ঝাঁপ দিয়ে মাংসপিণ্ড হয়ে । তার পর থেকে মেয়েটি নাকি খাদের তলা থেকে উঠে এসে সাহেবের কবরে মিলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে । জন্মজন্মান্তরে রূপ বদল করে করে আসছে ।  সাহেবও কবরে ছটফট্ করছে যন্ত্রণায়। রাত হলেই ওই বাংলোতে কাউকে টিঁকতে দিচ্ছে না ।  কারো কারো প্রাণও কেড়েছে। 

আমি নন্দলালকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে, রাতের খাবার এই ঘরে দিয়ে যেতে বলে বিদায় দিলাম। এখনো আরো কিছুক্ষণ এখানেই কাটাতে হবে। ঐন্দ্রিলার কাছাকাছি ঘেঁষা চলবে না।


         — পরিতোষ দা, আমরা নেমে পড়েছি। আপনিও চলে আসুন। আর দেরি হলে বাস মিস্‌ করব। গভীর রাতে ঐন্দ্রিলার কন্ঠস্বর শোনা গেল। আমি জেগেও ছিলাম, তৈরিও ছিলাম, কিন্তু ঐন্দ্রিলার সাথে সাথে যেতে ইচ্ছুক ছিলাম না।

– তোমরা এগোও – আমি রাস্তায় তোমাদের ঠিক ধরে ফেলব। বলে একটুক্ষণ কান পেতে থাকলাম। ওদের সাড়াশব্দ আর পাওয়া গেল না। স্বস্তির একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ঘরের বাইরে পা বাড়ালাম । দাঁড়িয়ে থাকা নন্দলালের হাতে গুঁজে দিলাম বখশিসের কিছু টাকা। গেট পেরিয়ে একটু দূর এগোতেই ‘ফোঁস্' করে একটা শ্বাস ফেলার শব্দ। মোবাইল-টর্চের আলোয় দেখলাম ......ঐন্দ্রিলা! ও কি আমার পিছু ছাড়বেই না?

ঐন্দ্রিলা আমার পাশাপাশি চলতেই লাগল। আমি ভয়ে ভয়ে আড়চোখে ওর গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে পা ফেলতে লাগলাম। কোন কথা বলে ওর কথা বলার উৎসাহ বাড়তে দিলাম না। অর্পণ আর দীপ্তিময় অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যেই  শনশন্ করে ছুটে চলেছে দূরপাল্লার ট্রাক। এই সুযোগে ঐন্দ্রিলা যদি আমাকে একটা ট্রাকের তলায় ঠেলে ফেলে দেয়। আমাকে বাঁচাবার মত কেউ তো আশপাশে নেই। 


আনমনে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে লাইটার দিয়ে সেটা ধরাতে উদ্যত হলাম। ঐন্দ্রিলা আমার দিকে বিষ-নজর হেনে আমাকে ফেলে রেখেই হনহন করে এগিয়ে গেল সামনে। ও কি লাইটারটাকে ভয় পেল, না আগুনটাকে?  এবার আমি অনেকটা নিশ্চিন্তমনে সিগারেটটা ধরিয়ে আকাশের মলিন চাঁদের আলোয় দেখলাম পাশেই ধানখেত আর তার পরেই টিলা দম বন্ধ করে কীসের যেন প্রতীক্ষা করছে। এমন সময় পায়ের স্যান্ডেলের পাশের চামড়ায় প্রচন্ড এক অগ্নিবাণ যেন বিদ্ধ হল । মোবাইল-টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম জাত-গোখরো তখনও ফণা দোলাচ্ছে। তখন আগুন আমাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। যন্ত্রণায় আমি মাটিতে চিৎ হয়ে পড়েছি। আমি আর্তনাদ করলাম – কেউ শুনল না। । আমি অতি কষ্টে হাত তুলে ইশারা করলাম – হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা ট্রাকও থামল না। চোখে নামল  ঘুমের আবেশ। ঘুমোনোর আগে ঘোর-লাগা অবস্থায় অনুভব করলাম আমার শিয়রে এসে বসেছে ওবেলা-য় পরিচয় পাওয়া সেই আদিবাসী মেয়েটি। চোখে বোধহয় তার আনন্দাশ্রু । এক হাত দিয়ে সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, অন্য হাতের অঙ্গুলিনির্দেশ করল শূন্যে।  সেই আঙুল অনুসরণ করে দেখি — টিলার মাথায় ও-ই দেখা যায় নীল সাহেবের বাংলো আর তার নিচের দিকে ‘ও'নীল’ লেখা কবর। মাথায় বিষ উঠছে — বিষ !  শিরা-উপশিরা জ্বালিয়ে দিতে দিতে উঠছে ।  উদ্ধার করবার কেউ নেই ।  অভ্যর্থনা করবার জন্যে আছে সেই অচেনা আদিবাসী মেয়েটি আর চেয়ে চেয়ে দেখবে ওই টিলার মাথার ভূতগ্রস্ত বাংলো । 


                     



২টি মন্তব্য:

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...