শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

রিমা দাস

 




              স্বাধীনতার রঙ

                



 


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাহান্ন বছর অতিক্রান্ত।সেইসময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরনার্থীরদের বেশ কিছু অংশ তাদের দেশ স্বাধীন হলেও রয়ে গিয়েছিল এ’দেশে।ক্রমে ক্রমে জীবিকার সন্ধানে তারা ভারতের নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পরে।তেমনিই একাংশ ঠাঁই নিয়েছিল উত্তরপ্রদেশে।পরবর্তীকালে তারা আবার উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের বসতি বানায়।এমনই জনগোষ্ঠী নিয়ে সেই রাজ্যের অখ্যাত এক গ্রাম খতৌলি।একবিংশ শতকে আজ সেই   গ্রামবাসীদের বাঙালি পরিচিতি প্রায় নেই বললেই চলে।গ্রামে বসবাসকারী মানুষগুলোর মুখের ভাষায় যতটা না বাংলা শুনতে পাওয়া যায় তার থেকে বেশী শোনা যায় হিন্দি বা অনেকসময় দুইয়ের মিশ্রণে একটা মিশেল ভাষা।লোকাচার সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে ভিন্ন রুপ।        


 


 সেই গ্রামেরই দশবছরের দুই বোন যমুনা আর প্রমীলা তাদের  ভাই রাজুকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের থেকে বেশ বড় মাপের একটা চটের থলে নিয়ে সূর্য ওঠার সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে  পড়েছে। প্রায় মাস সাতেক হল ৫৮ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ের উপর খতৌলি গ্রাম ছাড়িয়ে দেওবন্দ যাবার পথে ‘চিতল গ্রান্ড’ নামে একটা মোটেল চালু হয়েছে।তার আগে বছর তিনেক উত্তরপ্রদেশ হয়ে উত্তরাখন্ডের সংযোগকারী এই হাইওয়েতে ফোর  লেন তৈরীর কাজ চলছিল। ফলে সেইসময় এই  রাস্তা ধরে যাতায়াত করা বিশেষ সুখকর ছিলনা।এখন খোলনালচা পাল্টে সেই রাস্তাই একেবারে মাখনের মত মসৃন।ইতিমধ্যে উত্তরাখন্ডের রাজধানী হয়েছে দেরাদুন।এখন ভ্রমণ পিপাষুদের সাথে সাথে দেরাদুনকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। ফলে এই রাস্তায় রাতদিন গাড়িগুলো দিল্লি – দেরাদুন -মুসৌরী আপ-ডাউন করতে হুশহাস দৌড়ে চলেছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় সপ্তাহ শেষে গাড়ির চলাচল দ্বিগুণ বেড়ে যায় ফলে চিতলগ্র্যান্ডেও খদ্দেরের ভীড় উপচে পড়ে।


আজ সোমবার।গতকাল রোববারের সাথে শনিবারও কিসের যেন  একটা ছুটি ছিল।দোকানের বিক্রীবাট্টা স্বাভাবিকভাবে খুব ভাল হয়েছে।সক্কাল সক্কাল গেলে দোকানটার পিছনের কুড়াদান থেকে অনেক প্ল্যাস্টিকের জলের বোতল,কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল পাওয়া যাবে সেই সঙ্গে আধ খাওয়া ফেলে দেওয়া খাবার পাবার সম্ভাবনাও থাকে।সে আরেক আকর্ষণ।তাই আজ যমুনাদের বড্ড  তাড়া।


কাওয়াড়ীওয়ালার কাছে কুড়নো বোতল ইত্যাদি বিক্রী করে  যমুনাদের মন্দ টাকা হাতে আসেনি। সাথে কুড়িয়ে পাওয়া খাবারগুলোও তেমন নষ্ট না হওয়াতে তারা ভাইবোন মিলে তাড়াতাড়ি গাছের তলায় বসে আগেভাগে সেগুলোকে খেয়ে নিয়েছে।পাছে ভাগীদার এসে ভাগ বসায় সেই আশঙ্কাও মনে কাজ করছিল।সব মিলিয়ে তিন ভাইবোন বেজায় খুশী।গল্প করতে করতে একই ভাবনায় বাড়ির পথে তারা - মাই আজ আলু ছাড়া দুসরা একটা সব্জি জরুর বানিয়ে দেবে।মাঝ রাস্তায় হঠাত করে কালুর সাথে ওদের দেখা হয়ে যায়।


-  কী রে তোরা সব হাইওয়ের দিকে গিয়েছিলে?  


-  তুই কী করে জানলি?প্রমিলার পালটা প্রশ্ন।


-  এতো সকালে কভি তোদের বাড়ি থেকে বের হতে দেখিনি।তাই জিজ্ঞাসা করলাম।


কালু ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া।লিভার খারাপ হয়ে বিনা  চিকিৎসায় মা মারা যাবার পর বাপ হয়ে গিয়েছিল  তালুইমশাই। ছেলেকে ফেলে রেখে সে হয় নিরুদ্দেশ। প্রায় অভিভাবকহীন হয়ে কালুকে বেশ কিছুদিন এর দুয়ারে তার  দুয়ারে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হয়।বছর দেড়েকের  মাথায় বাপ আবার বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে গ্রামে এসে হাজির।কালু আবার ফিরে পায় মাথা গোঁজার আস্তানা।কিছুদিন গেলে সে অনেক আশা নিয়ে বাবার কাছে আবার   পড়াশুনার আর্জি জানালে বাপ খড়্গহস্ত হয়ে তেড়ে আসে।দু’বেলা রুটি জুটছে তাই ঢের পড়াশুনা করে সে বাপের কোন মাথা কিনে নেবে?সুগ্রীব দোসর নতুন মা পাশ থেকে ফোড়ন কাটে - বাজার আগুন চড়া।একা রোজগেরে বাপ। পেটে যেটা আছে তার কথা নাহয় এখন বাদই দিলাম,    কীভাবে তিনজনের খরচা লোকটা জোগায়?যার আয় করে সংসারে দু’পয়সা নিজের বাপের হাতে তুলে দেওয়া উচিত সে কিনা আরো খরচা বারাবার চিন্তা করছে।কালু সাহস নিয়ে বলে উঠতে পারে না তার মা বেঁচে থাকতে এই খরচায় তাদের চলে যেত।গৃহকর্তীর অন্তিম রায়ের পর বিনা উপার্জনে কালুর বাড়ি থাকা দুর্বিসহ হয়ে উঠল।তার অবস্থা দেখে আসিফ চাচা এগিয়ে আসে।তার বদৌলতে নতুন তৈরী এই মোটেলটায় কালুর বাসন মাজার সহকারী হিসাবে একটা হিল্লে হয়।বারো ঘন্টার ডিউটি সাথে দু’বেলা খাওয়া ফ্রী।সপ্তাহে একদিন ছুটী।বর্তমানে মাস গেলে দু’হাজার টাকা মাইনে পরে কাজ শিখে গেলে টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেওয়া হবে।আকাশের চাঁদ যেন কালুর কাছে এসে ধরা দিল।সে পেটের কষ্ট রক্তমজ্জায় জানে।তাই অনাথ যমুনাদের কষ্টও সে বোঝে।ওদের মদত করতে কালু গ্রামের থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের চিতলগ্র্যান্ডের পিছনের কুড়াদানের খবরটা দিয়েছিল।আজ আবার অন্য একটা খবর জানালো…


-  জানিস কী পুরকাজীতে একটা ইস্কুল আছে।ইংরাজী ইস্কুল। আমির ঘরের বালবাচ্চারা মুজাফরনগর থেকে ওই ইংরাজী ইস্কুলে পড়তে আসে।


পুতুল প্রশ্ন করে - উসসে ক্যায়া হুয়া?


-  আরে ইয়ার সামনে পন্দ্রা আগস্ট।ওইদিনটায় ইস্কুলটায় বহুত ভীড় হয়।ঠিক যেন মেলা লাগে।আমি দো চারবার দেখেছি।


-  ওতে আমাদের কী মতলব? কী বলছিস কিচ্ছু মালুম হচ্ছে না।


-  বেবাকুফ সব।উসদিন আমাদের আজাদী মিলেছিল।সাহেবরা  ভারত ছেড়ে ভেগে গিয়েছিল। আমরা আজাদ হয়েছিলাম।কথাগুলো বলে কালু বেশ গম্ভীরভাবে গর্বের সাথে তিনজনের দিকে তাকায়।সে যে ওদের থেকে জ্ঞানগম্যিতে একটু উঁচু দরের নীরব চাহনি দিয়ে তা বুঝিয়ে দিল।


-  ওইদিন ইস্কুলটায় ফাংশান হয়।বাচ্চারা ওদের বাবা-মা সব্বাই আসে।অনেক লোক হরেক কিসম জিনিস এনে ইস্কুলের গেটের বাইরে বিক্রী করে। পিছলে সাল বিক্রম  ভাইয়া আমায় সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল।ভারতের পতাকা বানিয়ে বিক্রী করেছিল। বহুত রুপিয়া মিলা থা।বিক্রম  ভাইয়া ত এখন দিল্লিতে চলে গেছে।ইস সাল তোরা পতাকা বানিয়ে নিয়ে যা।ভাল বিক্রী হবে,অনেক পয়সা পাবি।


দশবছরের রাজু প্রথম থেকে এদের সব কথা শুনে চলছিল।এবার সে কালুকে প্রশ্ন করে  


-লেকিন বানাব কী করে?পতাকা বানাতে আমরা কেউ জানিনা।


কালু বলে- ইতনা মুস্কিলও ভী নেহি।তোদের বাড়ি থেকে  একটু দূরে গোপালনানাজী ছোট একটা কিতাব কপির দুকান     খুলেছে।নানার দোকানে পতঙ্গ বানাবার পাতলা কাগজ পাওয়া যায়।সেখান থেকে নারঙ্গী,হরা,সফেদ কাগজ কিনে নিবি।জ্যাদা রুপিয়া নেহি লাগেগা।


পুতুল বলে -কিন্তু আমরা পয়সা কোথায় পাব?


-কেন আজ যা বিক্রী হল তার থেকে কিনে নিবি।


-মাই জানতে পারলে বহুত পেটাবে।


-কিছুটা ভারতী মসীকে দিস কিছুটা নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখ।


যমুনা কালুর কথায় খুব একটা আশ্বস্ত বোধ করে না।জিজ্ঞাসা করে -কাগজ খরীদ সে থোড়ি না হো জায়গা।   


-  কিঁউ নেহি হোগা!হরিচাচার দোকান থেকে দশটাকার ময়দা  কিনবি আর  একটা শিকওয়ালা ঝাড়ু।ময়দায় পানি মিশিয়ে পাতলা লেই বানিয়ে ফেলবি।ঝাড়ুর থেকে পাতলা লকড়ি  বার করে সবগুলোকে চাকু দিয়ে এক মাপের করে কেটে নিবি।ইসকে বাদ একরকম করে তিনটে রঙের কাগজগুলো কেটে উপরে নারঙ্গী মাঝে সফেদ বিলকুল নীচে হরা রঙের কাগজগুলো ওই লেই দিয়ে চিপকে দিবি।তারপর পতাকার  একধারে লেই লাগিয়ে কাঠিটাও চিপকাতে হবে।খেয়াল রাখিস নারঙ্গী রঙ সবসে উপর মে রহেগা।  


বিস্তারিত সব শুনে তিনভাইবোনের মুখগহ্বরে মাছি ঢুকে যায় অবস্থা। উত্তরপ্রদেশের ছোট্ট এক গ্রাম খতৌলির  ততোধিক ছোট্ট এক স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে অক্ষর জ্ঞানহীন অবস্থায় রাস্তার আবর্জনা কুড়িয়ে যাদের দিনযাপন তারা কীভাবে জানবে দেশের পতাকা বানাবার কারিকুরী।


 ভয়ে ভয়ে যমুনা বলে কিতনা সামান চাহিয়ে। আমাদের এত টাকা কোথায়?আর পতাকা বানাতেও আমরা জানিনা।কী করে  পারব?


-আচ্ছা আমি মদত করছি।কালু নিজের পকেট থেকে তিরিশ টাকা বার করে তার দুর্বলতার মানুষ যমুনার হাতে তা গুঁজে দেয়।


-তোর টাকা হম কিঁউ লেঙ্গে?মাই জানলে বকবে।


কালু গভীর দৃষ্টিতে যমুনার দিকে তাকিয়ে বলে- হর বাত  সবকো বোলনা নেহি চাহিয়ে।যখন তোদের বিক্রী ভাল হবে ভারতী মসী নিজেই কত খুশ হয়ে যাবে দেখবি।


   যমুনা চিন্তিত মুখে বলে - সে তো হল কিন্তু পতাকা তৈরী… বহুত দিক্কত লাগছে।


-চিন্তা করিস না।কাল আমার ছুটি।ম্যায় যা কে মদত কর দুঙ্গা।দেখবি ঝটপট হয়ে যাবে।শুধু লেই আর কাঠিগুলো  তৈরী রাখিস।


যথাসময়ে কালু যমুনাদের বাড়ি এসে সব দেখিয়ে দেবার পর চারজনে এবং যমুনাদের পালিতা মা সব্বাই হাত লাগিয়ে অনেকগুলো পতাকা বানিয়ে ফেললো।হিসাব করে দেখা গেল পাঁচ টাকা করে বিক্রি করলে লাভ মোটামুটি মন্দ হবে না। অপেক্ষার দিন গুনে মনে মনে প্রত্যেকে উত্তেজিত।


 


মুজাফরনগরের ‘সেন্ট পীটার’স্কুল।পনেরো অগস্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস।সকাল থেকে সাজো সাজো রব।বেলা বাড়ার সাথে সাথে স্টুডেন্টরা তাদের অভিবাকদের সাথে স্কুলে আসা শুরু করে দিয়েছে।সারাদিন ধরে চলবে নানা ফাংশান।স্কুলের বাইরে যথারীতি নানা বিক্রেতারা নিজেদের পসার সামগ্রী নিয়ে হাজির।


স্কুল গেটের উল্টোদিকের ফুটপাথে জোড়াতাপ্পি দেওয়া একটা চাদর বিছিয়ে যমুনারা ভাইবোনেরা তাদের কাগজের তৈরী পতাকা বিক্রী করতে হাজির হয়ে গেছে।আজ চারবছরের ছোটুর নিজের খুশীতে প্রায় পাগল অবস্থা।তার দাদা দিদিরা  তাকে বাড়িতে না রেখে এসে নিজেদের সাথে নিয়ে এসেছে।এখন তার জেদ চেপেছে সে বাচ্চাদের মতো বসে না থেকে বড়দের মতো কাজ করবে।কারণ সে বুঝে গেছে  কাজ না করলে বড় হওয়া যায় না আর বড় না হতে পারলে কেউ তার কথা শুনবে না।অগত্যা বড় হবার জন্য শুরু হল ছোটুর বায়না।ছোটভাইকে শান্ত করতে যমুনা  বুদ্ধিসহকারে তাকে একটা কাজ ধরিয়ে দিল।


   দিদির দেওয়া কাজ পালন করে বড় হবার আনন্দে কিছুক্ষণ পর দেখা গেল স্কুল গেটের বাইরে ছোটু কাগজের পতাকা নাড়িয়ে চিৎকার করে খদ্দেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলে চলেছে – আইয়ে আইয়ে পাঁচ রুপিয়া মে আজাদী লে যাইয়ে।


 

                   



 


 


 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...