বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪

চৈতালী ভৌমিক

 


                               তোমার জন্য




                                            



প্রাণের রবি ঠাকুর,


       তোমায় আজ খোলা চিঠি লিখতে বসেছি। জানি না এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবে নাকি। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সব বাবা -মা এর মতো আমার বাবা মা চাইতেন মেয়ে গান, আবৃত্তি শিখুক। তখন আমার বয়স ঐ সাত হবে। 'প্রশ্ন','দামোদর শেঠ' এসব শুধু পড়েছি। প্রথমবার ছোট্ট আঙুলে সঞ্চয়িতা থেকে নতুন ডায়েরীতে টুকতে বসলাম তোমার "দুই বিঘা জমি"। তুমি এটা পড়ে হাসবে আমি জানি। তা হাসতেই পারো।কিন্তু তখন টুকে মুখস্থ করার চেয়ে বেশি সাধ্য আমার ছিল না বাপু। ওটাতেই আমার প্রথম পুরস্কার আর গিফট যে দেয় ছোটোরা তাদেরই ভালোবাসে। তাই তোমাকেও বেশ ভালোবেসে ফেললাম।

         কিন্তু সময় তো পরিবর্তনশীল। ওটা কেমন জানি    পুরোনো হয়ে গেল,ডায়েরীর পাতায় তখন এলো "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ"। কিছু লাইন বুঝতে পারলেও ওরকম অদ্ভূদ নাম দেওয়ার কারণ বা অর্থ কোনোটাই বুঝলাম না । ছুটে গেলাম আমার সকল বিদঘুটে সুন্দর কৌতুহল মেটাতে পারা মানুষটার কাছে, আমার বাবা। বাবা বললেন, 'কবি একদিন ঘুম থেকে উঠে প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন এই কবিতা'। তবে এটাও একদিন আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল পাতায়।কত কবি এলো,কত কবিতা এল। ডায়েরীর মাঝের দিকের পাতায় তখন 'আফ্রিকা', 'দুই পাখি','পুরাতন ভৃত্য' একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে। তুমি ভাবছো কি মিথ্যুক মেয়েরে বাবা। এত কবির এত কবিতার পর মাঝের পাতা এখন! আসলে তোমায় আমি লিখতাম একদম আলাদা করে।

         বয়সের নিয়মে প্রেমে পড়লাম তখন আমি ঐ সতেরো কি আঠারো। প্রেম মানেই খুক খুক কাশি,বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে 'আমারও পরাণও যাহা চায়' এর দু- তিন লাইন। তোমাকে তো বলাই হয়নি এখন কিন্তু শুধু টুকে মুখস্থ করি না এখন তোমায় আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। কালের নিয়মে কাছের মানুষটা হাত ছাড়লো আটকাতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম "যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটেরও পথে,যদি অনুমতি করো কঠিন ব্রতে তব সহায় হইতে,যদি সুখে দুখে করো মোরে সহচরী  প তবে পাইবে আমার পরিচয়"। তবে আমাকে চেনার সময় তার ছিল না। সে বলেছিল 'এসব পাগলের প্রলাপ আউরে লাভ নেই। থাকো তোমার এসব ভাবনা নিয়ে।

        তোমার কবিতা আর গানে মনজুড়ে শান্তি অনুভব করলাম। তোমার লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম জীবনে এরকম ওঠা নামা যত চলবে তত বেশি সার্থক হবে জীবন।  তুমি মানে শুধু আবেগ নয়,অনুভূতি নয়; গভীর দুঃখে যেখানে স্বান্তনা ডুবে যায় সেখানের ভরসা তুমি। ক্রন্দনরতা নীরবে সহ্য করে চলা নারীর হঠাৎ অগ্নিদীপ্ত কন্ঠে "দাও খুলে দাও দ্বার,ব্যর্থ বাইশ বছর হতে পার করে দাও কালের পারাবার "এর রচয়িতা তুমি। প্রেমিকের শূন্য বুকের নীরবতা ভেঙে "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে" বলার শক্তি তুমি। তুমি মানে হিংসাকে পায়ে দলে ফেলে ভালোবাসার স্রষ্টা। যখন দুর্বল,অত্যাচারিত ক্ষমতাবানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ওঠে তার অনুপ্রেরণা তুমি। ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে বেরিয়ে আনন্দ উপভোগের যে অনাবিল আনন্দ তার সন্ধানকারী তুমি। বাঙালির কবিতা লেখার ইচ্ছা তুমি। তোমাকে কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রেই বেঁধে রাখার সাধ্য নেই কারোর।


    যাহ! তোমায় বলতে  একদম ভুলে গেছি। সাত বছর বাদে আচমকা একদিন মুখোমুখি হয়েছিলাম সে আর আমি। আমি উৎসুক চোখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম-কেমন আছো এখন?পাগলামি সহ্যের ঝক্কি তো আর নেই।

      "তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার,

       জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

       চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার-

       কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,নিয়েছ সে উপহার..." এক নিঃশ্বাসে বলতে বলতে তার হাতে থাকা ম্যাগাজিন ফেলে সে আমায় স্পর্শ করতেই আমি গলা মিলিয়ে দিলাম-


"আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে

  বিরহবধূর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে-

  পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে।"


বিস্মিত হয়ে দেখলাম এটা স্বপ্ন নয় এটা সত্যি। তখন

আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল ঠাকুর তুমি জিতে গেছো আবার। জানি এটা পড়ে তুমি মুচকি হেসে বলবে "পাগলি, আমি যে অন্তর্যামী। আমি তো সেজন্যই কথা দিয়েছিলাম, আমি থেকে যাবো সকলের অন্তরে।"

     মেঘবালিকা কথা দিয়েছে আমার চিঠি পৌঁছে দেবে তোমার কাছে। তুমি বলেছিলে না "বিশ্বাস হারানো পাপ"। তাই আমি বিশ্বাস হারাইনি ঠাকুর। আমি জানি সব ঝড় থেমে যাবে। অন্ধকার যত গাঢ় হয় তত তাড়াতাড়ি আলো আসার সময় আসে। বন্ধু, তুমি আবার 'আগুনের পরশমণি' ছুঁইয়ে দাও এই প্রাণে, 'তোমার খোলা হাওয়া' বইতে দাও এই মনজুড়ে। 'বরিষ ধরার মাঝে শান্তির বারি' দিও আবার।

'আলোকেরই ঝরনাধারায়' আবার ধুইয়ে দাও সকল মলিনতা, 'ভালোবাসি- ভালোবাসি এই সুরে আবার জলে স্থলে' বাঁশি বাজিয়ে স্বাভাবিক হোক জীবনযাপন।

     "আর, তার পরে?

তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল। স্বপ্ন আমার ফুরোল।"


              - তোমার   'সাধারণ মেয়ে'।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...