শনিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৩

সম্পাদকের কলমে

 







          শরৎ পার হয়ে হেমন্তে পা রাখলাম আমরা। উৎসব সময় আমাদের ঘিরে রেখেছে ওতপ্রোতভাবে। আপাত আলোর রোশনাই, গান, খাওয়া, নতুন জামার আনন্দ উপভোগ করতে পারছি এই বিশাল গ্রহের এক অংশের মানুষ। শারদ আনন্দ চলছে তবুও তার মধ্যেই কিছু ম্লান মুখ আমাদের শান্তিকল্যাণে দুঃস্বপ্নের মত ঘুরেফিরে আসছে। সিকিম সহ বাংলার উত্তর প্রান্তের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কয়েকদিন আগের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত। প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ এবং আমাদের রক্ষাকারী দেশের সুযোগ্য সন্তান সেনাবাহিনীর এক অংশ। সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে কষ্টার্জিত বহু সম্পদ। আমাদের দেশের কিছু দূরবর্তী উত্তর অংশে দুটি দেশে চলছে ভয়াবহ যুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাঞ্জা কষার খেলায় লক্ষ সাধারণ নিরীহ মানুষ অকালে মারা যাচ্ছেন, চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ব প্রাপ্ত হচ্ছেন। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধ পাচ্ছেন না তাঁরা। এই আক্রান্তদের প্রায় পঁয়ষট্টি শতাংশ মানুষ শিশু ও মহিলা, যাঁরা কেন যুদ্ধ চলছে তাই জানেন না। ভয়ঙ্কর লোভে উন্মত্ত পৃথিবী। আর এর মধ্যেই ফের প্রকাশিত হল অক্ষর বৃত্ত।

              


          সময়ের প্রকোপে আমরা মুদ্রিত সংখ্যা প্রকাশ করতে অক্ষম হয়েছি। তবুও সাহিত্যের প্রতি, সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় আমরা ফিরে এসেছি ওয়েবজিন সংখ্যায়। অসংখ্য কবি, লেখক তাঁদের মূল্যবান লেখা পাঠিয়ে আমাদের পাশে থেকেছেন এবারেও। সব লেখা আমরা প্রকাশ করতে পারিনি মানদণ্ডের কারণে। তবুও তার মধ্যেই যেটুকু পেরেছি তার জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমাদের সাহিত্য সমাজের প্রাপ্য।


          "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে / তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে / তবু প্রাণ নিত্যধারা,  হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/ বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে / তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে, / কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে / নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ,   নাহি নাহি দৈন্যলেশ / সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥" আনন্দ ও বেদনা, মিলন ও বিরহ, আগমন ও বিদায়, আর পুনরাগমন ও পুনর্মিলন,  প্রতিটি বছর আমাদের জীবন সারাংশেরই পুনরাবৃত্তি।  আমাদের এই আনন্দ সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ে সেটির উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর প্রত্যাশায়ই আরেকবার শুরু করি এই প্রত্যাশায় যে পৃথিবী আবার শান্ত হবে।


          মানুষ ভালো থাক, বাংলা ভাষা বিশ্বের সাহিত্য জগতের আনন্দ সভা আরেকবার আলোকিত করুক অক্ষর বৃত্তের এই শুভকামনা ধ্বনিত হোক বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজের কাছে। পাশে থাকুন সাহিত্যের।

                          

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

 



চক্ষু নির্মাণ পর্ব



তোমার পাথর চোখে স্কুলের ছুটির ঘন্টা

গ্রীষ্মের দিন কিছু ফুলের জন্মদিন।এই যে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গেল শূন্যতা কাটিয়ে সজল অশ্রুর পথে গানগুলো খুশি খুশি গায়।গড়ে ওঠে ভাঙা সম্পর্ক যেন ছিল যারা আবার ফিরেছে পুরনো ঘরের গমগমে। ঘাম তেল দিতে দিতে এই যে প্রতিমা জ্যান্ত যে কটা দিন কাছে পাওয়া ধন্য হৃদমন্ডপ।অন্ধমানুষের গল্প ফুরিয়ে আসে আমাদের চোখে পাতায় পাতায় বৈশাখীর নাচ বর্ষার আগে






যখন 



সন্ধ্যার গভীরে দেখি সন্ধ্যার বিষন্ন অসুখ

এই কুয়াশা জন্ম কে লিখে রাখে রাখার দেরাজে

অন্ধও মাঝেমাঝে শিউরে ওঠে এতো অন্ধকারে

কারা বসে আছে প্রত্যেকের কারাগারে

সব ক্ষত মেলে ধরে মৃত নক্ষত্রেরা 

আজ তবে আজকের গান বারুদ শূন্য

লিরিকের আশ্রয়ে সব আবহমান শব

নীরবতার নীর পাতায় পাতায় সজল 

এই মীড় অশ্রুত নয় শ্রুতির উজ্জ্বলতায় 

চুম্বন অসমাপ্ত রেখে তবে কে গেল বনে!



পৃথা রায় চৌধুরী

 কতোদূর... বহুদূর



সূর্য গলে যাচ্ছে

তোমার হাতে ফেলে এসেছি চোখ।


মনে পড়লো না আজ তোমার

তেষ্টার বোতল খালি রয়ে গেলো

প্ল্যাটফর্মের জলটুকু আগের মতোই

এখনো বহমান।


হাসি ঢেকে দেয় ধূপছায়ায়

কথাঝর্ণার খুনিঢোঁক

ধুতরো গেয়ে ওঠে অন্তিম পদাবলী,

জনান্তিকে...।


সন্ধ্যের কোলে অসহায় কালোকাচ

রাত্রি নামাতে ব্যস্ত

নিভে যায় পরসম্পদ আকাঙ্ক্ষা

আমের বাগান পেছনে সরে যায়

ঢেউ ভাঙ্গে নাকছাবি কুচি।


বোবা লেন্স... শাটার শাট আপ!


প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ

 



বাংলার বুকে আজ নির্জন অন্ধকার



                


এই যে, বাইরে এখন প্রবল বৃষ্টি। একান্ত নির্জন এবং নিরাবিল। দূরে বিচ্ছুরিত আলো চুপি চুপি কাঁদছে। তুমি কেমন আছো বালক? তোমার সমস্ত নগ্নতার ওপর ঝরে পড়েছে কি বৃষ্টি-ফোঁটা? নাকি তোমার সমাধিস্ত অস্তিত্বের গায়ে প্রবাহিত হচ্ছে রক্তস্রাব...! তুমি কি জানো, বাংলার বুকে আজ নির্জন অন্ধকার! সমগ্র দেশ জুড়ে উদযাপিত হচ্ছে রাত্রিকালীন পরাজয়! তোমার ভূখণ্ড থেকে সমস্ত মোমবাতি নিভে গেছে আজ। তুমি জানো না বালক, ওরাও তো তোমারই মতো কত রাত মিছিলে হেঁটেছে! স্বপ্ন ফেরি করবে বলে ক্রমশ ক্রমশ ক্রমশ বিকিয়ে গেছে নগ্নতার কাছে...

ওরা আজ বধির

কর্মহীন ঈশ্বর

অন্ধ চরাচর

তবু, তুমি ভিজতে ভিজতে ভিজতে তোমার অপারগ ঠোঁটে একটু একটু করে সেলাই করেছ নিশ্চুপ প্রতিবাদ। তবু, ভেজা কাচের গায়ে পৃথিবী আজ আবছা-- অস্পষ্ট...!



অগ্রন্থিত শব্দ-কথন


কবিতা লিখব বলে কেটে গেছে গোটা একটা বেলা। একটা দিন। মাস। বছর। অগ্রন্থিত সময়ের চলন। তারপর... তারপর... নুয়ে পড়েছে নিয়ত রাতের আলো। তবু আমরা মাঝে মাঝে কবিতা লিখি। অক্ষরশ্রমিকের খাতায় উড়িয়ে দিই ধুলো-ঝড়। অরণ্য-রোদন। সেইসব কান্নারা ফিরে ফিরে আসে, আবার চলে যায়। আমাদের পাশে রেখে যায় শিরোনামহীন কিছু শব্দ-আলো... 


আমার ঘরময় এখন হলুদ আলোর রঞ্জক। প্রজাপ্রতি বিকেলের পাশে ছড়িয়ে পড়া আলপনা-সন্ধে। চাঁদ আর অভিমানে নত হওয়া মেঘ। আমিও বিগত জন্মের আড়ালে ঘুমিয়ে পড়েছি শব্দহীন কাঠঠোকরা এক। আমার বসতবাড়িতে মেঘ এসে বসেছিল অভিমান বিলোতে বিলোতে। দু'দণ্ড বিশ্রাম নেবে বলে। তারপর অভিসারে যাবে তারা। কামরাঙা রঙের বন। গাছেদের অহংকারী রমন। কামিনী ফুল ও মাধবীলতা মেখে অভিসারে যাবে তারা... 


আমিও অভিসারী পথিক হয়ে বসে আছি অপেক্ষার পথে। অগ্রন্থিত রাতের কিনারে। আলোর বিনুনি ধরে দু'একটা অক্ষর আসবে বলে... বসে আছি... বসে আছি আজন্মকাল... বসে বসে পথিকের ক্রন্দন শুনি। তবু বসে আছি... বসে আছি... বসে আছি...


নবনীতা চক্রবর্তী

 



চিকু কথা 




খুটখাট শব্দটা স্টোররুমের দিক থেকেই আসছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য টনি দরজায় কান পেতে আবার শুনল আওয়াজটা। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, এই শুনশান দুপুরে। খুব আস্তে, স্টোররুমের দরজাটা খুলে লাইট জ্বালে টনি। আওয়াজ বন্ধ। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হঠাৎ, চালের ড্রামের পাশ দিয়ে, সোঁ করে কাবার্ডের পিছনে একটা বড় সাইজের ধেড়ে ইঁদুর চলে গেল। 


সেইথেকে, ইঁদুরটা নাজেহাল করে ছাড়ছে সবাইকে। সারাদিন চুপচাপ। কেউ টেরটি পায়না। কিন্তু দুপুরে টনি টের পায় তার অস্তিত্ব। স্টোররুমটাই আস্তানা গেড়েছে। রাতে আসল কারসাজি শুরু করে। ময়লার বালতি উল্টানো, বাসনকোসন ফেলা ইত্যাদি তার নিত্যকার কাজ হল। কিন্তু অশান্তি উর্দ্ধে উঠল, যখন রান্নাঘরে মিটসেফের তারজালি কেটে শুকনো খাবারদাবার বাইরে ফেলতে শুরু করল। টনি ইতিমধ্যে, দুপুরবেলা চুপিচুপি ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে ইঁদুরমশাইকে দেখেছেও, যাতায়াত পথটিও আবিষ্কার করেছে। আরও দেখেছে, খালি গ্যাস সিলিন্ডারের পিছনে শুকনো ডাল, মুড়ি এমনকি একটা মাছের কাঁটাও জমানো। বুঝেছে, এটা তারই কাজ। টনি, ঠামির কাছে গল্পে শুনেছে, জীবজন্তুরা ছানাপোনা হলে তাদের জন্য খাবার জমায়। খুব মায়া হল টনির। ক্রমে, ইঁদুরটাকে রোজ দেখতে পেত এবং ধীরে ধীরে টনিকেও যেন সে আর ভয় পেতনা ততো। টনি ওকে বন্ধু ভাবল এবং নাম দিল চিকু। টনির মনে হল, চিকুও যেন রোজ দুপুরে তার জন্য অপেক্ষা করে। 


বাড়িতে সেদিন বিকেলের চা নিয়ে মা, জেঠি, রাঙাপিসি ও ঠামি গোলটেবিলে বৈঠক বসিয়েছে। ঠামির পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছে টনি। মা বলল,"ইঁদুরের ব্যবস্থা করতে হবে এবার। খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ভাঁড়ার ঘর থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। ওখানেই মনে হয় আস্তানা গেড়েছে"। ঠামি বুদ্ধি দিল, কাল তার আদরের বিল্লি, গুল্লুকে ওই ঘরে ঢোকাবে ইঁদুরের সন্ধানে। টনি প্রমাদ গুনল। গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল, কিভাবে বাঁচাবে চিকুকে। 


ঠামির কোলে বসে গুল্লু চোখ বুজে আদর খাচ্ছে দেখে, গুল্লুর উপর খুব রাগ হল টনির। মা-জেঠি কাজ সেরে গুল্লুকে স্টোররুমে ঢুকিয়ে, দরজা ভেজিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর ধূপধাপ আওয়াজে দরজা খুলে দেখা গেল আটার ড্রাম উল্টে চারিদিকে আটা ছড়ানো। গুল্লুকে দেখা যাচ্ছে না। ঠামি গুল্লু বলে ডাকল। সারা গায়ে আটা মেখে ভূত সেজে গুল্লু আটার ড্রাম থেকে বার হল। ইঁদুর বাবাজিকে কোথাও দেখা গেল না। আনন্দে টনি হাততালি দিল। মনে মনে বলল, "অত্ত সহজ! চিকুকে ধরা"! 


চিকুর দৌড়াত্ম্য কিন্তু বহাল রইল। কিন্তু টনি তো জানে যে চিকু বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করার জন্যই এসব করছে। টনি অনেক সাবধান করলেও, চিকু সেকথা বুঝলে তো! এবার বিষ প্রয়োগের পরিকল্পনা চলছে বাড়িতে। টনি কেঁদে পড়ে এবার। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করল। জেদ করে বলে, ইঁদুর মারা চলবে না। ইঁদুরটাকে যে সে দেখেছে এবং বন্ধু পাতিয়েছে টনি সেসব কথা সবাইকে বলল। আরও বলল যে ওর নাম রেখেছে চিকু। 


টনির জেঠু সব শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে বিষ নয়, ইঁদুরের কল দিয়েই চিকুকে ধরা হবে এবং পরে ভাবা যাবে যে কি করা হবে। সেইমতো, কলটা পাতা হল স্টোররুমে। টনি ভাবে,"হায়রে না-মানুষ!! এত বুদ্ধি তোর! তাও মানুষের কলেই তোকে ধরা দিতে হবে"! 


পরদিন চিকুকে সবাই দেখল। ধূসর রঙের বড়সড় একটি ইঁদুর। লাল পুঁথির মতো অসহায় দুটো চোখ দিয়ে সবাইকে দেখছে। জেঠু তখন চিকুসহ ইঁদুরকলটা প্লাস্টিকে ভরে, টনিকে পিছনে বসিয়ে স্কুটারে স্টার্ট দিল। পার্কের কোণায় এসে একটা বড় গাছের সামনে, জেঠু কলের মুখটা খুলে দিল। কিচকিচ করে নিমেষের মধ্যে চিকু গাছ বেয়ে উঠে গেল। জেঠু স্বর্গীয় একটা হাসি হেসে কোলে তুলে নিল টনিকে। 


দীপক জানা

 অন্ধকারের ভেতরেই




অন্ধকার মাখছে শব্দরা 

বিজ্ঞাপনের বাৎসায়নে ধ্রুবতারা

ক্রমশ ওয়ারিশন সার্টিফিকেট থেকে মুছে যাচ্ছে চিহ্ন

টাওয়ারের ওপর এসে বসলো তিনটে দাঁড়কাক


যারা কাক শাস্ত্র জানে, বুঝে নেবে

কাকবোলের খাদ্যগুণ

অথচ আজ ঘড়িতে কোনো অমঙ্গল যোগ ছিল না জেনেই

বিজোড় শালিক এসে বসলো ভিক্টোরিয়ার মাঠে


জ্যোৎস্না মোছা ভাঙা চাঁদ হুমড়ি খায়

গলায় কাঁটার মতো অবাধ্য যানজট

সিগন্যাল পেরোনো জীবন

বারবণিতার হাতে কোজাগরী আলো সাজে

ধূপে-দীপে পুড়ে যায় সন্ধ্যাটা

কোথাও কি পেঁচা ডেকে উঠল? 


নীলম সামন্ত

 মেধাবী সমাচার





মেধাকে হোটেলের বলরুম ধরে নিলে 

স্পষ্ট হয় মস্তিষ্কের আয়তন 

যেখানে আমরা না চাইলেও দু একটা ভাঙা প্লেট 

কিংবা ওয়েটারের হাতে অল্প একটু ময়লা 

থেকেই যায়


যাইহোক, আপাতত ব্রেকফাস্ট টেবিলের পাকা পেঁপের কথা বলি 

পিস পিস করে কাটা 

প্রশ্নহীন 

সুইমিং পুলের দিকে তাকিয়ে নাচতে নাচতে ঢুকে যাচ্ছে 

পাকস্থলীর মধ্যগগনে 


কোন বুক জ্বালা নেই

মাথা ব্যথা নেই 

এমনকি পেটে মোচড়ও নেই 


সারমর্মটা বুঝলেন তো?

মস্তিষ্ক বা মেধা যেমনই হোক না কেন 

প্রশ্নহীন থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না৷ 

.

.


সঙ্গীতা মুখার্জী মণ্ডল

 সময়ের উপাখ্যান




একে একে মেঘগুলো যখন ঝরে পড়ে

একটাও আমার বুক ভিজিয়ে দিয়ে বলে না 

আমি তোর;

আমি নিঃস্ব হয়ে পড়ি

অকালেই সৌন্দর্যের আয়ু ক্ষয় হয়

হলুদ বসন্ত আসে না আমার ঘরে

ছুটে ছুটে যায় শহরের অলিগলি

জীবনের চৌরাস্তায় সকাল সাঁঝে। 

কিন্তু ভয় কোথায় কি উল্টে যায়

কঠিন অক্ষর বোঝার আগেই

আমি হারিয়ে ফেলি

প্রতিটা অশ্রুর এলোমেলো ভাবনা

সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে, নিঝুম...

আমি ক্লান্ত চোখে শব্দের বাটখারা হাতে

গুণিতক হতে বাবার সুখের আশায়

আকাশ দেখি

চুরি করি সময়ের উপাখ্যান।


সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

 এল-টাইমো 




ভাঙছে 

হাতুড়ি, গজাল 

চৌচির, চওড়া চিবুক, বুনোবর্ণের গাল 

ভ্রূ কুঁচকে আকাশের গিলে করা নীল 



 কালো মেঘ, ক্রমশ অসন্তোষে বিপ্রবর্ণ কালো 

গর্জনে নীল বিদ্যুৎ, শব্দে ভয়ঙ্করী।



হাড়ের অন্তরে প্রস্তর যুগের রাবিশ, কন্ঠস্বরে 

                                     এলোমেলো হাওয়া 

খিদে ওল্টানো হাঁড়ির একপেট ধোঁয়া ঊর্ধগামী 




স্নানহীন স্নানাগারে শ্যাওলা শুকিয়ে।




অদূরে থ্রেটজোন ইকনমির রঙরুট হাসি 

আওয়াজের বিভিষিকা কেন্নো গুটিয়ে 

নিস্তব্ধতা এমন যে দু'কানের শ্রুতিপর্দায় ঘুম নেমে এসে জানালো আদাব:



মঁসিয়ে সময়, তবে কি এইবার তুমি 

এল টাইমোর ম্যাজিক দ্যাখাবে?


সম্পা পাল

 বলার কিছু নেই






প্রত‍্যেকবার রাস্তা মাপার আগে জ‍্যামেতির বাক্স খুঁজে দেখি অতীত ,বর্তমান ,ভবিষ‍্যতের কাটাকুটি !

পরবর্তী অংশটা ঠিক হলো তো !


জানি আমার ছাতা নেই ।

আপনার  নিয়তি নেই।

সুতরাং  বলার কিছু নেই।


আপনি খুঁজে দেখেননি কতটা পেলেন ?

আমিও লিখিনি না পেয়ে কতটা হারালাম !


আপনি হয়তো জীবন ভালোবাসেন !

কেউ মৃত‍্যুকে ...


দীপায়ন ভট্টাচার্য

 


সুলেভান গোমস্








সুলেভান গোমস্ কে, আমি তার কী জানি? হ্যাঁ,  আমি হয় তো তাকে দেখেছি। কিন্তু তাকেই যে দেখেছি, সে কথা আজও অনেকে মানতে চাইছে না। তাদের বক্তব্য, ওই নামে আশপাশের দশ গাঁয়ে কেউ নেই – থাকত না । না থাকলে আমার কী করার আছে ? কিন্তু সন্ধেবেলার আলো-আঁধারির প্রহেলিকায় শালবাগানের নদীবাঁধে কেউ যদি আচমকা আমার মুখোমুখি হয় এবং সে-ই নিজের মুখে যদি নিজেকে সুলেভান গোমস্ বলে চেনায়, আমার কি তাকে অন্য কেউ বলে সন্দেহ করবার কোন কারণ আছে? তার আত্মপরিচয় দেওয়া থেকেই আমি তাকে চিনেছি, কিন্তু তার আদ্যোপান্ত যে জেনে গিয়েছি অমন দাবি তো করি নি । তাহলে লোকে আমার কথার ওপর এত অনাস্থা প্রকাশ করে কেন !  


একটু আগে থেকেই তাহলে ঘটনার বিবরণ শুরু করতে হয়। সন্ধের মিটমিটে আলোয় আমাকে শালবাগান পর্যন্ত দৌড় করতে হয়েছিল দুলি ছাগলটার দোষে। ছাগলটাকে বাঁধাবাঁধির কোন ব্যাপার নেই। সেই সুযোগে যখন-তখন সেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, আবার আপন খেয়ালখুশিমত ফিরেও আসবে। কেবল মাঝে মাঝে বোধহয় তার বেভুল হয়ে যায়। হয় তো পথ হারিয়েই এদিক-সেদিক ঘুরতে থাকে। এমনি করে সূর্যদেব যখন সন্ধের চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে চলে যান, তখন আমাকেই বেরোতে হয় ছাগল খুঁজতে। কখনো স্কুলের মাঠ, কখনো বাঁশঝাড় থেকে আমি তাকে আবিষ্কার করে আনি। আজকে ওসব জায়গা খোঁজা হয়ে গেছে। শেষ ভরসা একটু দূরের এই শালবাগান। অনেক শালগাছের ভিড় এখানে। প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার বিস্তার। মাঝখানে তুনাই নদী তাকে দু'ফালি করে দিয়ে দূরে কোথাও চলে গেছে। বর্ষা ছাড়া এ নদীতে জল বিশেষ থাকে না। কিন্তু এক-একটা বর্ষাতেই  তার চেহারায় কেমন মস্তানি ভাব চলে আসে। তার ওই বর্ষার ধাক্কা সামলাতেই দু'পাশে মজবুত বাঁধ দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা। ওই বাঁধটাই শালবাগানের ভেতর- বাইরে চলাচলের পথ। সে পথ দিয়েই এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে চলছিলাম 'দুলি দুলি' ডাক ছাড়তে ছাড়তে। সন্ধের আকাশী বারান্দায় চাঁদ তখন আসন পেতে বসব বসব করছে। তুনাই নদী থেকে পেঁজা তুলোর মত ধোঁয়া উঠে রওয়ানা দিচ্ছে কোথায় কে জানে। গাছের নাকি প্রাণ আছে। যদি থাকে, মটকা মেরে সারি সারি গাছ কি গণনিদ্রার আয়োজন করছে ? ভাল করে দেখা যাচ্ছে না কিছুই, আবার আবছাভাবে অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে আশপাশের ঝোপঝাড় চিরে কী যেন সড়সড়্ করে সরে গেল। শেয়ালটেয়াল হবে হয় তো। ভয় তো এদেরকেই। দুলি যদি এ জঙ্গলেই ঢুকে থাকে, এদের পেটের কৃষ্ণগহ্বরে যাবে না— তা-ই বা কে বলতে পারে। না— অন্তত একটা গাছের ডাল ভেঙেও হাতে নিয়ে নেওয়া ভাল। তাই করলাম। এরই মধ্যে কী করে যেন পায়ের মধ্যে বিছুটি পাতা লেগে তার কাজ শুরু করে দিল। চুলকোনোর জন্যে নিচু হয়ে বসতে না বসতেই শুনতে পেলাম দুলির মিহি গলার ছাগুলে ডাক,সঙ্গে একটা ধাতব কড়কড়ে আওয়াজ। যাক— শয়তানটা কাছেপিঠেই কোথাও আছে। ভাবতে ভাবতেই দুলি একেবারে আমার সামনে। না---- হেঁটে হেঁটে বা ছুটে ছুটে নয়। এক্কেবারে লম্বামত একটা লোকের কোলে চেপে। ছাগল নামিয়ে রাখার সময় দেখলাম তার ডান হাতে একটা বালা। সোনার কি লোহার জানি না। ভাল করে তাকিয়ে বুঝলাম, লোকটির পোশাক আশাকও আমাদের এদিককার মত নয় ---- অন্য রকম। লোকটি বলল –--- ছাগলটাকে একটু সামলে রেখো ভাই, এ জঙ্গলটা কিন্তু ভাল না। 

---- হ্যাঁ, আসার পথেও দু'একটা শেয়ালের আনাগোনা টের পেলাম। আমি বললাম ।  

----শুধু শেয়াল নয়, কয়েকদিন ধরে আশপাশের চা-বাগান থেকে একটা চিতাবাঘও এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে।

---- কী সব্বোনাশ!

---- তাই তো বলছি, দুলি-কে এখন থেকে একটু বেঁধেছেঁদে রেখো। 

---- আপনি ওর নামও জানেন !

---- তোমাকেও জানি। থট রিডিং। যাক গে– চলো, তোমাকে জঙ্গলটা পার করে দিয়ে আসি। জঙ্গলটা ভাল নয়। নদীটা আরো খারাপ ---- বিচ্ছিরি।

---- আপনার বাড়ি কোথায় ?

---- এখানেই আছি।

---- এখানে কারো বাড়ি আছে বলে তো শুনি নি ! 

---- সব কি আর শুনেছ ? এই যে আমার নাম সুলেভান গোমস্ তা-ও কি তোমার শোনা আছে ?

---- না: । 

---- তবে চুপচাপ আমার সাথে চলো।


আমরা চলতে লাগলাম। ধাতব শব্দটা আবার শোনা যেতে লাগল। সুলেভান একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে মনে হল । মনে হল, কিন্তু অন্ধকারে ভাল করে কিছু বোঝা গেল না ।

জঙ্গলের প্রান্তসীমায় এসে সুলেভান বাঁধ থেকে নেমে তুনাই নদীর দিকে চলে গেল। একটু পরে আবার ফিরেও এল। 

----একটা কথা তোমাকে বলা হয় নি –-- ধর্মবিশ্বাসে আমি কিন্তু খ্রীস্টান। 

---- সে তো আপনার নাম শুনেই বুঝতে পেরেছি।

---- সবকিছু বুঝতে পার নি। তাই তো কথাটা বললাম ।  তোমাদের কালীদাদুকেও তো বলেছিলাম। তার দ্বারা তো কিছু হল না। যাক গে ---- এখন চলি ।


সুলেভান চলে গেল। আমিও চলে এলাম। তারপর থেকেই বাড়ল বিড়ম্বনা। ওই নামটাকেই কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না। উল্টে আমাকে দেখলেই বিটলে বন্ধুরা মিচকে হেসে বলতে লাগল – ওই যে আসছেন সুলেভান গোমস্ । 


রেগেমেগে একদিন কালীদাদুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছেলেবেলায় তার কোলেপিঠে কত ঘুরেছি। তিনি আমাকেই চিনতে পারলেন না, সুলেভান গোমস্  তো অনেক পরের কথা। আগেই অবশ্য শুনেছিলাম, তার স্মৃতিভ্রংশ রোগ হয়েছে। বয়েস আশির কোঠায় পৌঁছোলে কারো কারো নাকি অমন হয়। অগত্যা আমি সুলেভান প্রসঙ্গ একেবারেই ত্যাগ করলাম। কেউ তুলতে চাইলে আমিই তাকে এড়িয়ে যেতাম। আস্তে আস্তে প্রসঙ্গটাই থিতিয়ে গেল। এমনি করেই আমার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব পরীক্ষা পেরোনো হয়ে গেল। গ্রাম ছেড়ে এখন যেতে হবে শহরের কলেজে। এমন সময় আবার হঠাৎ গরমাগরম আলোচনায় গ্রামীণ জীবন সরগরম হয়ে উঠল। শালবাগানের তুনাই নদীতে  নাকি খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে প্রাচীন ---- অতি প্রাচীন একটা বড়সড় নৌকোর উপরিভাগ জেগে উঠেছে। তুনাই নদীর এখন যা অবস্থা, তাতে অত বড় নৌকো চলাচলের কোন পরিসরই নেই। কিন্তু প্রাচীনকালে এই নদীতেই নাকি জোয়ার-ভাঁটা খেলত। হাতে নাতে এই তো প্রমাণ পাওয়া গেল। গ্রামের অনেকে গিয়ে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে এল। এরই মধ্যে হই হই করে পুরাতত্ত্ব বিভাগের লোকজন গিয়ে জায়গাটা ঘিরে সন্তর্পণে গোটা নৌকোটা খুঁড়ে নিয়ে চলে গেল। আর তখনই আগুনের ফুলকির মত ছড়িয়ে পড়ল আরেক সংবাদ। নৌকোর সাথে নাকি শেকল-বাঁধা অবস্থায় একটা নরকঙ্কালও পাওয়া গেছে। খবরের পরের অংশটা আমার ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে গেল ---- কঙ্কালের হাতে নাকি একটা সোনার বালা পাওয়া গেছে, যার মধ্যে প্রাচীন ইংরেজিতে খোদাই করা ---- এস.জি। গ্রামের সবজান্তারা বলার চেষ্টা করেছিল, ওটা এই এলাকার প্রায় উপকথা হয়ে যাওয়া ডাকাত সাবলু গড়াইয়ের কঙ্কাল। কিন্তু এর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ স্বর্ণজিৎ সরকার বললেন, ওটা কিছুতেই সাবলু গড়াইয়ের হতে পারে না। কারণ, তার জীবৎকাল আজ থেকে শ' আড়াই বছর আগে আর কার্বন টেস্টে জানা গেছে কঙ্কালটা প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো । 


এখন আমি বুঝে গেছি আমাকে কী করতে হবে। সরকারি লোকদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শহরের চার্চ সংলগ্ন কবরস্থানে বিধিনিয়ম মেনে কঙ্কালটাকে কফিনসহ কবরস্থ করবার ব্যবস্থা করতে হবে — করতেই হবে। সুলেভান গোমস্ যে আমাকে বলে গিয়েছে, সে ধর্মবিশ্বাসে খ্রীস্টান।

       

             


প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়

 ভালোবাসা কখনো অনুমতি চায় না 



 


তুমি তো জানো 

ভালোবাসার প্লেটে সৌন্দর্যের ওজন কতো ? 


অগোছালো আমি ,‌ এই প্রশ্নটি আমাকে উর্বর উদ্বেগ দেয়‌ । কতোটা ফর্মের ফাঁদে আটকে গেলে , দৃষ্টি ফেরত হাসি , সহজ হতে হতে অনুভূত ধারনা , তোমার সত্ত্বাতে ভ্রমণের অনুমোদন‌ করে । 


চশমা এবং আত্মার জানালা যখন‌ কবিতা হতে চেয়ে স্তবকগুলির প্রিমিয়ার করার জন্য প্রস্তুত , আমি ভাবি 

তোমার ঠোট , চুম্বনের দাবি রাখে 

আয়নার ঘুরে যাওয়া বিকেলের অনুবাদে‌ 


ভালোবাসা কখনো‌ অনুমতি চায় না


সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...