শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 সেই  রাত




রাস্তায় এত জ্যাম যে স্টেশনে পৌঁছাতে খুব দেরি হয়ে গেল।চারদিকে আলো,মোড়ে মোড়ে কালীপুজো।এখন 

বয়স হয়েছে এসব আদিখ্যেতা আর ভালো লাগে না।

যে ট্রেনে বসলাম সে ছাড়তে বিলম্ব করল।বাদাম চিবিয়ে পেটের আগুন একটু নিভলো।প্রারা ঘন্টা দুয়েক লাগবে যেতে।বসার সিট বেশিরভাগ ফাঁকা। আমার মতো কিছু অভাগা কাজ সেরে ফিরছে ক্লান্ত শরীরে।এক ঘন্টার মধ্যে ওরাও নেমে গেল।সুয্যিপুর ছাড়িয়ে মাঝপথেই আবার দাঁড়িয়ে ট্রেন।সিগন্যাল পায়নি বোধহয়।আলোগুলো নিভে গেলো।ঘুমিয়ে নিই একটু। 

কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না আশপাশে খুচরো আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো।বগির ম্লান আলোয় একটু বিস্মিত হলাম।এরা আবার কখন উঠলো।সিটগুলো প্রায় ভর্তি।সবই গ্রামের মানুষ।গরিব। লুঙ্গি পরে কেউ ছেঁড়া মলিন সার্ট।

---"একটা বিড়ি হবে"

ভুল শুনলাম কি! 

নাহ্ ,আমার পাশ ঘেঁষে এসেছে একটা নোংরামতো লোক।কিন্তু কথাটা বোধহয় বললো ওই সাইডের জানলার কাছে বসা কেউ।

দুটো বউ মুড়ি দিয়ে বসা।

ঢুলছে না ঝুলছে বোঝা যায়  না অন্ধকারে।

বিরক্তি  চেপে বিড়ি এগিয়ে দিই। পুরো প্যাকেটটাই ছুঁড়ে ফেলি।

এখন শুধু লাল লাল আগুনের বিন্দু।লোকগুলোকে চোখে পড়ছে না।চোখটা দেখাতেই হবে।

---" আজ ভূতচতুদ্দশী ",

"হে হে",

"হুম হু",

হাহা"

"হ্যাঁ জানি।এত হাসির কী আছে এতে!"__আমি বিরক্ত গলায় বললাম। 

রাগ ধরে যায়।খিদে ঘুম,ক্লান্তি সব মিলিয়ে পা যেন চলছে না আর।

আমার স্টেশন এলে নেমে পড়লাম।পেছন ফিরে তাকিয়ে অবাক। একি!

ট্রেনটা তো ফাঁকা একদম।কেউ নেই। না থাকারই কথা এটাই ত শেষ স্টেশন।

কিন্তু কখন নামলো ওরা?একটু আগেই তো ছিল আশেপাশে।

স্টেশন শূন্য। লোক নেই একটাও। অতোগুলো লোক গেল কোথায়।স্টেশন থেকে নেমে শুনশান পায়ে হাঁটা পথ।

দোকানে দোকানে আলো দেখা যাচ্ছে।অস্পষ্ট শ্যামা সঙ্গীত ভেসে আসছে।দূরে দূরে পুজো প্যাণ্ডেলে মাইক বাজছে।ক্রমে আলোকিত পথ শেষ।

ডোবার ওপারে বিরাট খেলার মাঠ।কতগুলো আলো ঘুরছে।জোনাকি।ডোবার দিকে একটু আলোর ফুলকি।আমরা ছোটবেলায় বলতাম আলেয়া।আসলে মিথেন প্রভৃতি গ্যাস থেকে উৎসারিত বিক্রিয়া।

আমার বাড়ি দূরে আগাছার মধ্যে ঝুপসি অপেক্ষায় আমার জন্য।

তালা খুলে ঢুকবো।বাড়ি তো নয় শূন্য ভুবন।

মার কথা খুব মনে পড়ে।বাবা।আর আমার প্রাণাধিক প্রিয় ভাই। আজ সবাইকে মনে পড়ছে। আজকের দিনে বাড়ি সেজে উঠত আলোয়।মা ঘরে তৈরী করতেন প্রদীপ। 

 আমার বউ সবিতা সারা বাড়ি প্রদীপ দিয়ে সাজাতো।

আজ কেউ নেই।একে একে সবাই চলে গেছে এই দুবছরে।চোখে জল এলো।

ভালোবেসে বেসে তারপর প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে না পেরে একছড়া দড়ি হাতে সে চলে গেছিল এমন নিকষ রাতে বটের ডালের কাছে মুক্তি চেয়ে।আমার ভাই। 

মা সেই শোকে চলে গেল গত পাঁচ বছর আগেই।

 বাবা আর পোয়াতি বউ আমার রইল।তারপর কী যে হলো।বাবা চলে গেল মারণ ভাইরাসে।হঠাৎ ই। সবিতাও।তেমন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি।

এক্কেবারে বলা নেই কওয়া নেই একা হয়ে গেলাম।

আমার কিছু  হলো না কিন্তু। আমি  পড়ে রইলাম এই ফাঁকা বাড়িতে।

 আমি আর আমার অন্ধকার বাড়ি। 

খাবার ঘরের আলোটা মনে হয় কেটে গেছে।আলোটা কাঁপছে।লোডশেডিং হবে নাকি।

না।কিন্তু সিরিস হয়ে টিম টিম করতে লাগল আলো।ওর মধ্যেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হাত ধুলাম।খাবার রেখে গেছে কাজের বউ।

খাটে বসি।ঝিম লাগে ক্লান্তি তে।খাটের তলা থেকে একটা শীর্ণ হাত বেরিয়ে আসছে।কে??

কে যেন মার শূন্য ঘরের কোণে গুটি সুটি বসে আছে। আরষ্ট, বুড়িমতো।

চোখে জল দিই।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধহয়।

--"খেতে এসো" ভুল শুনলাম?

হ্যাঁ,এভাবেই ত বউ ডাকতো।

কিন্তু খাবার ঘরে গিয়ে আমি চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়লাম।

টেবিলে সবকটা চেয়ার ভর্তি।মাঝখানে মোমবাতি।গলে গলে ঝরে পড়ছে মোম।

মা,বাবা,ভাই, বউ সমবেতভাবে তাকালো হেসে।

মাথাটা ঘুরে যাবে যেন।কী ভীষণ অন্ধকার ওদের মুখের ভেতরটা।

কী বিকৃত হয়ে গেছে মুখগুলো হাসিতে আর খিদেতে 

আমি স্থানু র মতো বসলাম চেয়ারে।মাস রক্তহীন হাড় বার করা কঙ্কালসার আমার আত্মীয় সব।

সবাই চেয়ে আছে আমার দিকে।ঘোলাটে চোখ।পাতাহীন।মরা মাছের মতো।

সিরসিরে হাত আমার মাথায়। মা!!

বউয়ের বরফ নিশ্বাস।

উফ,আমার আর কিছু মনে নেই।


পরে অনেকবার ভেবেছি।

বিষণ্ণ হয়েছি।কেন।

কেন ভয়!মৃতদের।

আমারই ত মা ,বাবা যাদের হারিয়ে কেঁদেছি রাতের পর রাত।আজ সামনে দেখে ,নিজের মা কে দেখে আতংকে হিম হয়ে গেলাম।কেন।

যে সবিতা ভুগে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে মরে গেলো তখন আমিও চেয়েছিলাম আত্মহত্যা করতে শোকে।আর আজ!

তাকে দেখে ভয় পেলাম কেন!!

মানুষ মৃত হলে কি ভালোবাসাও ভূত হয়ে  যায়! মা বউ বাবা ভাই কেউ না।

শুধু জীবন সত্য! 

আর কিছু  নয়


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...