শনিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৩

নবনীতা চক্রবর্তী

 



চিকু কথা 




খুটখাট শব্দটা স্টোররুমের দিক থেকেই আসছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য টনি দরজায় কান পেতে আবার শুনল আওয়াজটা। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, এই শুনশান দুপুরে। খুব আস্তে, স্টোররুমের দরজাটা খুলে লাইট জ্বালে টনি। আওয়াজ বন্ধ। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হঠাৎ, চালের ড্রামের পাশ দিয়ে, সোঁ করে কাবার্ডের পিছনে একটা বড় সাইজের ধেড়ে ইঁদুর চলে গেল। 


সেইথেকে, ইঁদুরটা নাজেহাল করে ছাড়ছে সবাইকে। সারাদিন চুপচাপ। কেউ টেরটি পায়না। কিন্তু দুপুরে টনি টের পায় তার অস্তিত্ব। স্টোররুমটাই আস্তানা গেড়েছে। রাতে আসল কারসাজি শুরু করে। ময়লার বালতি উল্টানো, বাসনকোসন ফেলা ইত্যাদি তার নিত্যকার কাজ হল। কিন্তু অশান্তি উর্দ্ধে উঠল, যখন রান্নাঘরে মিটসেফের তারজালি কেটে শুকনো খাবারদাবার বাইরে ফেলতে শুরু করল। টনি ইতিমধ্যে, দুপুরবেলা চুপিচুপি ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে ইঁদুরমশাইকে দেখেছেও, যাতায়াত পথটিও আবিষ্কার করেছে। আরও দেখেছে, খালি গ্যাস সিলিন্ডারের পিছনে শুকনো ডাল, মুড়ি এমনকি একটা মাছের কাঁটাও জমানো। বুঝেছে, এটা তারই কাজ। টনি, ঠামির কাছে গল্পে শুনেছে, জীবজন্তুরা ছানাপোনা হলে তাদের জন্য খাবার জমায়। খুব মায়া হল টনির। ক্রমে, ইঁদুরটাকে রোজ দেখতে পেত এবং ধীরে ধীরে টনিকেও যেন সে আর ভয় পেতনা ততো। টনি ওকে বন্ধু ভাবল এবং নাম দিল চিকু। টনির মনে হল, চিকুও যেন রোজ দুপুরে তার জন্য অপেক্ষা করে। 


বাড়িতে সেদিন বিকেলের চা নিয়ে মা, জেঠি, রাঙাপিসি ও ঠামি গোলটেবিলে বৈঠক বসিয়েছে। ঠামির পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছে টনি। মা বলল,"ইঁদুরের ব্যবস্থা করতে হবে এবার। খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ভাঁড়ার ঘর থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। ওখানেই মনে হয় আস্তানা গেড়েছে"। ঠামি বুদ্ধি দিল, কাল তার আদরের বিল্লি, গুল্লুকে ওই ঘরে ঢোকাবে ইঁদুরের সন্ধানে। টনি প্রমাদ গুনল। গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল, কিভাবে বাঁচাবে চিকুকে। 


ঠামির কোলে বসে গুল্লু চোখ বুজে আদর খাচ্ছে দেখে, গুল্লুর উপর খুব রাগ হল টনির। মা-জেঠি কাজ সেরে গুল্লুকে স্টোররুমে ঢুকিয়ে, দরজা ভেজিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর ধূপধাপ আওয়াজে দরজা খুলে দেখা গেল আটার ড্রাম উল্টে চারিদিকে আটা ছড়ানো। গুল্লুকে দেখা যাচ্ছে না। ঠামি গুল্লু বলে ডাকল। সারা গায়ে আটা মেখে ভূত সেজে গুল্লু আটার ড্রাম থেকে বার হল। ইঁদুর বাবাজিকে কোথাও দেখা গেল না। আনন্দে টনি হাততালি দিল। মনে মনে বলল, "অত্ত সহজ! চিকুকে ধরা"! 


চিকুর দৌড়াত্ম্য কিন্তু বহাল রইল। কিন্তু টনি তো জানে যে চিকু বাচ্চাদের খাবার জোগাড় করার জন্যই এসব করছে। টনি অনেক সাবধান করলেও, চিকু সেকথা বুঝলে তো! এবার বিষ প্রয়োগের পরিকল্পনা চলছে বাড়িতে। টনি কেঁদে পড়ে এবার। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করল। জেদ করে বলে, ইঁদুর মারা চলবে না। ইঁদুরটাকে যে সে দেখেছে এবং বন্ধু পাতিয়েছে টনি সেসব কথা সবাইকে বলল। আরও বলল যে ওর নাম রেখেছে চিকু। 


টনির জেঠু সব শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে বিষ নয়, ইঁদুরের কল দিয়েই চিকুকে ধরা হবে এবং পরে ভাবা যাবে যে কি করা হবে। সেইমতো, কলটা পাতা হল স্টোররুমে। টনি ভাবে,"হায়রে না-মানুষ!! এত বুদ্ধি তোর! তাও মানুষের কলেই তোকে ধরা দিতে হবে"! 


পরদিন চিকুকে সবাই দেখল। ধূসর রঙের বড়সড় একটি ইঁদুর। লাল পুঁথির মতো অসহায় দুটো চোখ দিয়ে সবাইকে দেখছে। জেঠু তখন চিকুসহ ইঁদুরকলটা প্লাস্টিকে ভরে, টনিকে পিছনে বসিয়ে স্কুটারে স্টার্ট দিল। পার্কের কোণায় এসে একটা বড় গাছের সামনে, জেঠু কলের মুখটা খুলে দিল। কিচকিচ করে নিমেষের মধ্যে চিকু গাছ বেয়ে উঠে গেল। জেঠু স্বর্গীয় একটা হাসি হেসে কোলে তুলে নিল টনিকে। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...