শনিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৩

দীপায়ন ভট্টাচার্য

 


সুলেভান গোমস্








সুলেভান গোমস্ কে, আমি তার কী জানি? হ্যাঁ,  আমি হয় তো তাকে দেখেছি। কিন্তু তাকেই যে দেখেছি, সে কথা আজও অনেকে মানতে চাইছে না। তাদের বক্তব্য, ওই নামে আশপাশের দশ গাঁয়ে কেউ নেই – থাকত না । না থাকলে আমার কী করার আছে ? কিন্তু সন্ধেবেলার আলো-আঁধারির প্রহেলিকায় শালবাগানের নদীবাঁধে কেউ যদি আচমকা আমার মুখোমুখি হয় এবং সে-ই নিজের মুখে যদি নিজেকে সুলেভান গোমস্ বলে চেনায়, আমার কি তাকে অন্য কেউ বলে সন্দেহ করবার কোন কারণ আছে? তার আত্মপরিচয় দেওয়া থেকেই আমি তাকে চিনেছি, কিন্তু তার আদ্যোপান্ত যে জেনে গিয়েছি অমন দাবি তো করি নি । তাহলে লোকে আমার কথার ওপর এত অনাস্থা প্রকাশ করে কেন !  


একটু আগে থেকেই তাহলে ঘটনার বিবরণ শুরু করতে হয়। সন্ধের মিটমিটে আলোয় আমাকে শালবাগান পর্যন্ত দৌড় করতে হয়েছিল দুলি ছাগলটার দোষে। ছাগলটাকে বাঁধাবাঁধির কোন ব্যাপার নেই। সেই সুযোগে যখন-তখন সেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, আবার আপন খেয়ালখুশিমত ফিরেও আসবে। কেবল মাঝে মাঝে বোধহয় তার বেভুল হয়ে যায়। হয় তো পথ হারিয়েই এদিক-সেদিক ঘুরতে থাকে। এমনি করে সূর্যদেব যখন সন্ধের চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে চলে যান, তখন আমাকেই বেরোতে হয় ছাগল খুঁজতে। কখনো স্কুলের মাঠ, কখনো বাঁশঝাড় থেকে আমি তাকে আবিষ্কার করে আনি। আজকে ওসব জায়গা খোঁজা হয়ে গেছে। শেষ ভরসা একটু দূরের এই শালবাগান। অনেক শালগাছের ভিড় এখানে। প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার বিস্তার। মাঝখানে তুনাই নদী তাকে দু'ফালি করে দিয়ে দূরে কোথাও চলে গেছে। বর্ষা ছাড়া এ নদীতে জল বিশেষ থাকে না। কিন্তু এক-একটা বর্ষাতেই  তার চেহারায় কেমন মস্তানি ভাব চলে আসে। তার ওই বর্ষার ধাক্কা সামলাতেই দু'পাশে মজবুত বাঁধ দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা। ওই বাঁধটাই শালবাগানের ভেতর- বাইরে চলাচলের পথ। সে পথ দিয়েই এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে চলছিলাম 'দুলি দুলি' ডাক ছাড়তে ছাড়তে। সন্ধের আকাশী বারান্দায় চাঁদ তখন আসন পেতে বসব বসব করছে। তুনাই নদী থেকে পেঁজা তুলোর মত ধোঁয়া উঠে রওয়ানা দিচ্ছে কোথায় কে জানে। গাছের নাকি প্রাণ আছে। যদি থাকে, মটকা মেরে সারি সারি গাছ কি গণনিদ্রার আয়োজন করছে ? ভাল করে দেখা যাচ্ছে না কিছুই, আবার আবছাভাবে অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে আশপাশের ঝোপঝাড় চিরে কী যেন সড়সড়্ করে সরে গেল। শেয়ালটেয়াল হবে হয় তো। ভয় তো এদেরকেই। দুলি যদি এ জঙ্গলেই ঢুকে থাকে, এদের পেটের কৃষ্ণগহ্বরে যাবে না— তা-ই বা কে বলতে পারে। না— অন্তত একটা গাছের ডাল ভেঙেও হাতে নিয়ে নেওয়া ভাল। তাই করলাম। এরই মধ্যে কী করে যেন পায়ের মধ্যে বিছুটি পাতা লেগে তার কাজ শুরু করে দিল। চুলকোনোর জন্যে নিচু হয়ে বসতে না বসতেই শুনতে পেলাম দুলির মিহি গলার ছাগুলে ডাক,সঙ্গে একটা ধাতব কড়কড়ে আওয়াজ। যাক— শয়তানটা কাছেপিঠেই কোথাও আছে। ভাবতে ভাবতেই দুলি একেবারে আমার সামনে। না---- হেঁটে হেঁটে বা ছুটে ছুটে নয়। এক্কেবারে লম্বামত একটা লোকের কোলে চেপে। ছাগল নামিয়ে রাখার সময় দেখলাম তার ডান হাতে একটা বালা। সোনার কি লোহার জানি না। ভাল করে তাকিয়ে বুঝলাম, লোকটির পোশাক আশাকও আমাদের এদিককার মত নয় ---- অন্য রকম। লোকটি বলল –--- ছাগলটাকে একটু সামলে রেখো ভাই, এ জঙ্গলটা কিন্তু ভাল না। 

---- হ্যাঁ, আসার পথেও দু'একটা শেয়ালের আনাগোনা টের পেলাম। আমি বললাম ।  

----শুধু শেয়াল নয়, কয়েকদিন ধরে আশপাশের চা-বাগান থেকে একটা চিতাবাঘও এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে।

---- কী সব্বোনাশ!

---- তাই তো বলছি, দুলি-কে এখন থেকে একটু বেঁধেছেঁদে রেখো। 

---- আপনি ওর নামও জানেন !

---- তোমাকেও জানি। থট রিডিং। যাক গে– চলো, তোমাকে জঙ্গলটা পার করে দিয়ে আসি। জঙ্গলটা ভাল নয়। নদীটা আরো খারাপ ---- বিচ্ছিরি।

---- আপনার বাড়ি কোথায় ?

---- এখানেই আছি।

---- এখানে কারো বাড়ি আছে বলে তো শুনি নি ! 

---- সব কি আর শুনেছ ? এই যে আমার নাম সুলেভান গোমস্ তা-ও কি তোমার শোনা আছে ?

---- না: । 

---- তবে চুপচাপ আমার সাথে চলো।


আমরা চলতে লাগলাম। ধাতব শব্দটা আবার শোনা যেতে লাগল। সুলেভান একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে মনে হল । মনে হল, কিন্তু অন্ধকারে ভাল করে কিছু বোঝা গেল না ।

জঙ্গলের প্রান্তসীমায় এসে সুলেভান বাঁধ থেকে নেমে তুনাই নদীর দিকে চলে গেল। একটু পরে আবার ফিরেও এল। 

----একটা কথা তোমাকে বলা হয় নি –-- ধর্মবিশ্বাসে আমি কিন্তু খ্রীস্টান। 

---- সে তো আপনার নাম শুনেই বুঝতে পেরেছি।

---- সবকিছু বুঝতে পার নি। তাই তো কথাটা বললাম ।  তোমাদের কালীদাদুকেও তো বলেছিলাম। তার দ্বারা তো কিছু হল না। যাক গে ---- এখন চলি ।


সুলেভান চলে গেল। আমিও চলে এলাম। তারপর থেকেই বাড়ল বিড়ম্বনা। ওই নামটাকেই কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না। উল্টে আমাকে দেখলেই বিটলে বন্ধুরা মিচকে হেসে বলতে লাগল – ওই যে আসছেন সুলেভান গোমস্ । 


রেগেমেগে একদিন কালীদাদুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছেলেবেলায় তার কোলেপিঠে কত ঘুরেছি। তিনি আমাকেই চিনতে পারলেন না, সুলেভান গোমস্  তো অনেক পরের কথা। আগেই অবশ্য শুনেছিলাম, তার স্মৃতিভ্রংশ রোগ হয়েছে। বয়েস আশির কোঠায় পৌঁছোলে কারো কারো নাকি অমন হয়। অগত্যা আমি সুলেভান প্রসঙ্গ একেবারেই ত্যাগ করলাম। কেউ তুলতে চাইলে আমিই তাকে এড়িয়ে যেতাম। আস্তে আস্তে প্রসঙ্গটাই থিতিয়ে গেল। এমনি করেই আমার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব পরীক্ষা পেরোনো হয়ে গেল। গ্রাম ছেড়ে এখন যেতে হবে শহরের কলেজে। এমন সময় আবার হঠাৎ গরমাগরম আলোচনায় গ্রামীণ জীবন সরগরম হয়ে উঠল। শালবাগানের তুনাই নদীতে  নাকি খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে প্রাচীন ---- অতি প্রাচীন একটা বড়সড় নৌকোর উপরিভাগ জেগে উঠেছে। তুনাই নদীর এখন যা অবস্থা, তাতে অত বড় নৌকো চলাচলের কোন পরিসরই নেই। কিন্তু প্রাচীনকালে এই নদীতেই নাকি জোয়ার-ভাঁটা খেলত। হাতে নাতে এই তো প্রমাণ পাওয়া গেল। গ্রামের অনেকে গিয়ে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে এল। এরই মধ্যে হই হই করে পুরাতত্ত্ব বিভাগের লোকজন গিয়ে জায়গাটা ঘিরে সন্তর্পণে গোটা নৌকোটা খুঁড়ে নিয়ে চলে গেল। আর তখনই আগুনের ফুলকির মত ছড়িয়ে পড়ল আরেক সংবাদ। নৌকোর সাথে নাকি শেকল-বাঁধা অবস্থায় একটা নরকঙ্কালও পাওয়া গেছে। খবরের পরের অংশটা আমার ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে গেল ---- কঙ্কালের হাতে নাকি একটা সোনার বালা পাওয়া গেছে, যার মধ্যে প্রাচীন ইংরেজিতে খোদাই করা ---- এস.জি। গ্রামের সবজান্তারা বলার চেষ্টা করেছিল, ওটা এই এলাকার প্রায় উপকথা হয়ে যাওয়া ডাকাত সাবলু গড়াইয়ের কঙ্কাল। কিন্তু এর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ স্বর্ণজিৎ সরকার বললেন, ওটা কিছুতেই সাবলু গড়াইয়ের হতে পারে না। কারণ, তার জীবৎকাল আজ থেকে শ' আড়াই বছর আগে আর কার্বন টেস্টে জানা গেছে কঙ্কালটা প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো । 


এখন আমি বুঝে গেছি আমাকে কী করতে হবে। সরকারি লোকদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শহরের চার্চ সংলগ্ন কবরস্থানে বিধিনিয়ম মেনে কঙ্কালটাকে কফিনসহ কবরস্থ করবার ব্যবস্থা করতে হবে — করতেই হবে। সুলেভান গোমস্ যে আমাকে বলে গিয়েছে, সে ধর্মবিশ্বাসে খ্রীস্টান।

       

             


৫টি মন্তব্য:

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...