সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১

অক্ষর কথা


 


 


 

দিন দুয়েক জল ঝরিয়ে আকাশ ফের চুপচাপ। এই বাংলা বর্ষ জুড়ে বৃষ্টিপাত একেবারেই ভালো হয় নি। আশায় বাঁচতে বাঁচতে চাষা মাথা নুইয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। প্রকৃতির উত্তাপ বেড়েই চলেছে ক্রমান্বয়ে।

 

তবুও প্রকৃতিকে কিছুটা হলেও মোকাবিলা করা যায় সম্পন্নের বাতানুকূল যন্ত্রে, নিম্ন মধ্যবিত্তের ঝেড়েমুছে চালানো যান্ত্রিক পাখায়, গরীবের হাত পাখা, বেলের পানা, লেবু জল আর প্রাচীন প্রাকৃত গাছের ছায়ায়। কিন্তু মানুষের তৈরী উত্তাপকে সামাল দেবে কার এত বুকের পাটা!

 


মানুষের তৈরী উত্তাপ আসলে বাড়তে থাকা লোভের আগুনের ঝলক। রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনী খেলা। আসরে তাল ঠুকে নেমে পড়েছে বিভিন্ন রণংদেহি রাজনৈতিক দল। এখন সব জিনিস, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মতই রাজনীতিরও বেহাল দশা। সেই মানের হিমালয় সদৃশ নেতা নেত্রীর বড়ই আকাল। ফলে ক্ষমতা কায়েমের বিপুল লিপ্সায় আকাট জনতাকে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পরস্পরের বিরুদ্ধে। বাড়ছে উত্তাপ।



 

গত উনিশের শেষ মাস থেকে যে মহামারী পৃথিবীকে নিজের থাবার তলায় নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলতে শুরু করেছিল, তাকে আজও শান্ত করা যায় নি। দৈনিক আক্রান্ত আর মৃত্যুর হার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বাড়ছে আশংকার, ভয়ের উত্তাপ। তবে আশার কথা একটাই এখন মানুষের হাতে এসে গেছে প্রতিষেধক। যদিও তা কতখানি কার্যকরী সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময় এখনো আসে নি।

 

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই দীর্ঘ সময় পরে আবার প্রকাশিত হলো অক্ষর বৃত্ত। পাঠকের ভালোবাসা, স্রষ্টার ভালোবাসা অস্বীকার করতে পারে না অক্ষর বৃত্ত। তাই লেখা আহ্বান থেকে শুরু করে প্রকাশ পর্যন্ত এবং পাঠকের স্পর্শানুভূতি পাওয়ার জন্য আপনাদের হাতে এলো আপনাদের আপন ভালোবাসাজন অক্ষর বৃত্ত।

 

ভালো থাকুন সবাই। আনন্দে মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে প্রতিদিন আসুক সবার জীবনে। শুভ হোক নতুন বছর।












রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়


একবার, যদি একটিবারও পাই, তোমাকে



 

যদি আর একখানা শীতকাল পাই, সিলভিয়ালাল এঁকে দেব ঐ ঠোঁটে

 

যদি আর দুখানি শীতকাল পাই, ছিনিয়ে আনবই

এভারেস্টচূড়ার বরফ ছুঁয়ে থাকা হিম থেকে প্রিয় কাশ্মীরি শাল,

তুমি তো অবাক, এ ফুটো পকেটের হাল লোকটা কীভাবে

 

যদি তিনখানা শীতকাল পাই,

মাইরি বলছি, শীতফুল দিয়ে আর সাজাব না এ বাগান,

দেখব, সারাটা দুপুর সমস্ত নরম রোদ পিঠে নিয়ে তুমি এভাবেই

সব মরশুমি ফুল

 

যদি আর চারটে, কিংবা, নয় দশ, এগারো,

জন্মান্তরে বিশ্বাসী আমি, দুত্তোর,শালা নিকুচি করেছে

 

আর একবার,ভুলস্বপ্নেও যদি একটিবারও ,

 

তোমাকেই

 

         

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শ্যামল সরকার

জয়

 

 

 

কখনো কখনো সময় পিছিয়ে পড়ে

নতুন ভাবনার মোট মাথায় হেঁটে যায় কাঠকুড়ুনি

পেছন থেকে চেয়ে থাকে হবিতব্য

সময় মুখ লুকায় অদৃষ্টের আঁচলে

 

বহেমিয়ান ভাবনার গর্ভে

জন্ম হয় নতুনের

 

সময় হেরে গেলে

               জয় হয় ভালবাসার

 

সুচরিতা চক্রবর্তী

চরিত্র চিত্রকর

 

চরিত্রে প্রদত্ত কোনো  শ্লোক প্রয়োজন

মূল গল্প থেকে  অচ্যুত ।

যুদ্ধ ,যুদ্ধ ক্ষেত্র , নাড়ী নক্ষত্র  নির্বাচন সমীচীন ।

ক্ষত্রিয়, আমার খুব প্রিয় এক  শব্দ

যতদিন ভারত ততদিন একটাই  মহাভারত

মহাভারতের প্রতিটা নারী চরিত্রই, আমি।

নিঃসঙ্গ মনস্বিনী  অভিকর্ষণ মন্ত্র ধারিণী

লাঞ্চিত অবাঞ্চিত অথবা  প্রেমময়ী চরিত্র

 সঙ্গচ্যুতা আবার ধর্মপত্নী,  আমিই। 

 

সঠিক নির্ণায়ক না হলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নেই

যক্ষী সর্পী মানুষী সমস্ত চরিত্র এক জীবনেই।

 

দীপঙ্কর বেরা

 

হারান

 

মাচানতলার বস্তিতে শুধু হাহাকার দেখে হারান। কে যে কি কাজ করে, কি খায় কে জানে? শুধু খাওয়া আর খাওয়ার জোগাড়ে দিন কেটে যায়।

- নে নে পা চালা। তখন থেকে বলছি। আর তুই চাল বাছতে সময় নিলি।

হারানের কথায় মুখ ঝামটা দেয় বিনি - অনেক হয়েছে। এবার তো চল।

হারান জানে ওর শরীর আর পেরে উঠছে না। ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর বিনি যে ক'টা চাল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে তাও কাঁকরে ভর্তি।

আকাশের দিকে তাকিয়ে হারান বলে - মনে হয় আজ দেরি হয়ে গেল। ক'দিন ইস্কুলে মিডডে মিল দিচ্ছে না। গরমও পড়েছে খুব। আজ খুব বিক্রিবাটা হবে।

বিনিও চিন্তার সুর তোলে - তাই তো গো বাপ, সাহিল ফ্যাক্টরি থেকে আইসক্রিমও নিতে হবে। চলো, পা চালাও।

- মেয়ে আমার বড় হয়ে গেল। সব বোঝে।

মুচকি হাসে বিনি - তা আর হব না। দু মুঠো যোগাড় করতে তোমার শরীরের এই হাল। তাও আমাকে ছাড় নি।

- ছাড়ব কি রে, আমি ভাবছি উল্টো কথা। ওই স্কুলের ভেতরে তুই আর আমি বাইরে তোর রেজাল্টের অপেক্ষায়। আইসক্রিম বেচছে অন্য কেউ।

হাসবে না করেও হেসে ফেলে বিনি -  কি করে হবে? কে আমরা তাই তো জানি না। কেউ যখন নিল না তুমি তো আমাকে কোলে তুলে নিলে। নাম দিলে বিনি।

খালি পা। তাই উঁ হঁ করে হারান গম্ভীর জবাব দেয় - আমারও তাই। কে যেন ডাকল হারিয়ে যাস না। তাই আমি হারান।

হাতের বাক্সটা আরো ভালো করে গুছিয়ে ধরে বিনি এগিয়ে যায়। হারান বলে - জানিস মা, এতে সুবিধা আছে। আমরা কে হিন্দু কে মুসলিম কেউ জানে না। ফলে আমাদের পূজো আচ্চা কিছু নেই। আমরা শুধু মানুষ। আমরা খেয়ে না খাওয়ার আর না খেয়ে খাওয়ার দাঙ্গা করি।

বলেই হাসির চোটে কাশি এসে যায় হারানের। লুঙ্গি ধরে বলে - জানিস, আর বোধ হয় লুঙ্গিতে হবে না। স্কুলে বাবুদের ছেলেরা কেমন তাকায়। কিন্তু কেউ ডাস্টবিনে ভালো একটা প্যাণ্টও তো ফেলছে না।

হারান দূরের দিকে তাকায়। বলে - দেখ তো মা। ওরা কি কোন মাপজোক করছে।

- হ্যাঁ।

- তাহলে আবার ঠিকানা বদল। যাচ্চলে।

 

কৃপাণ মৈত্র

আবর্ত অবিরাম

            

 

অতীতটা দেবাঞ্জন বর্তমানে বাসা

ভবিষ্যৎ ভাবীকালে আছে কাঁদাহাসা,

তবুও  একটা জনম একটা ধরাধাম

মনমুকুরের চিত্রকথায় আবর্ত অবিরাম।

       

 সময় তো বহমান সঙ্গমের টানে

পাপ পুণ্য থিতু হয় খরতর বানে ,

আমার অসীম তৃষা শুধু আমাতে

অবশিষ্ট রবে না কিছু খরচ জমাতে।  

আবদুস সালাম

বিবর্ণ পাঠশালা 


 

অস্বস্তিকর প্রস্তাবে প্রবন্ধের পৃষ্ঠাগুলো সংকুচিত হয়

নৈরাত্মার ঢেউ লাগে বিবর্ণ পাঠশালায়

পড়ুয়াহীন পাঠশালায় অবিন‍্যস্ত পাঠক্রম

বিশ্বাস এখানে  নিহত হয় রোজ

 

গোপন ঈর্ষায় জেগে ওঠে চিত্রশালা

সংসারের বিন‍্যস্ত প্রহরে খেলা করে মাতাল অস্তিত্ব

ঝাপটা খায় বৃদ্ধ বিশ্বাস

খুঁটি উপড়ে যায়

অর্ধ দগ্ধ ভোর উঁকি মারে চৈতন্যের বাগানে

 

রুদ্ধ ঠোঁটে থাবা বসায় প্রণয় কথা

গুমরে মরে উৎসব পৃথিবীর দলীয় অহংকার

 তবুও দুঃখী চাঁদ বিষন্ন আলো জ্বেলে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে

স্বর্ণব দত্ত

২১শে ফেব্রুয়ারী



কন্ট্রাক্টরের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো বিকাশের,ভীড় বাস,বেলা তখন বারোটা ,"ভাড়াটা মিটিয়ে ঘুমোতে পারেন তো দাদা! বলেহারি ঘুম আপনার,বেলা বারোটা সময় এতো ঘুম!", কন্ট্রাক্টরের কথায় আশেপাশের লোকজনও মুচকি হাসলো, কারোর কথাই কর্ণপাত না করে ভাড়া মিটিয়ে দিল বিকাশ,মনে মনে ভাবল সত্যিই তো বারোটা সময় কেউ ঘুমায়?,সব তার কপাল! এই তো কথা শোনা শুরু , কাজে আজও দেরী করেই পৌঁছাবে সেইখানেও কথা শুনতে হবে,রোজ রোজ কথা শুনে এখন আর গায়ে লাগে না তার,নিদ্রাহীন রাতের গল্প প্রতিদিন আর কত শোনাবে সবাইকে, সবাই ঠাট্টা করে,। দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে বের করে,খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় হরপে লেখা ,"২১শে, ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস",মায়ের কথা মনে পড়ে যায় বিকাশের,তার এই অবস্থার জন্য দায়ী তার মা,বছর দুয়েক হল মা অসুস্থ,কি যে রোগ কেউ জানে না,বার বার ডাক্তার পরিবর্তন, ঔষধ পরিবর্তন করেও লাভের লাভ কিছু হয় নি,মনে মনে অনুতাপে ভোগে সে,তবে আজ মায়ের সাথে ব্যাবহারটা ভালো করে নি সে,মা যেন সেরে উঠছে না,কেমন যেন বাতিকগ্ৰস্ত হয়ে উঠেছে মা, আগে এমন ছিল না, ডাক্তার বলে দিয়েছেন কোনো রোগ নেই ,সব মনের রোগ,এবার পাগলের ডাক্তার দেখাতে হবে তাকে,বেসরকারি অফিসের দারোয়ানের কাজ করে কটা টাকা বা তার আসে তার মধ্যে মায়ের পিছনে এত খরচ করে পেরে উঠছে না সে,টান পড়ছে সংসারে,ছেলেটার দিকে নজর দিতে পারছে না সে,তোমার মায়ের রোগ কোনো দিন ঠিক হবে না,আমি কি কিছু বুজি না বাপু সব কাজ না করার ধান্দা আর টাকার ধ্বংস ,ওর জন্য আমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে",- বেনুর কথা গুলো গায়ে ছ্যাকা দিয়ে ওঠে বিকাশের,কিছু বলে উঠতে পরে না সে।আজ সব সহ্য না করতে পেরে মাকে অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছে সে,উত্তর সে পেয়েছে তবে মুখের কথায় নয়,মায়ের মুখের ভঙ্গিমা সব উত্তর দিয়েছে তাকে,চোখে অশ্রু ধারায় অসহায় মা বিকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ,"বাবু, শেষবারের মতো ঔষধ গুলো এনে দিই,দেখবি এবার আমি ঠিক হয়ে যাবো", মায়ের সেই মুখটা মনে পড়ে গেলে বুকটা কেঁপে ওঠে বিকাশের, ঝাপসা হয়ে আসা চোখে অতীতের কথা মনে পড়ে বিকাশের এর আগেও এত টানাটানির সংসারে মা তো বিকাশ অসুস্থ হলে এইরকম ব্যবহার করে নি, মায়ের উপর মায়া হয় বিকাশের,দু চোখ ভরে জল আসে তার,মা যেন প্রথম থেকেই অসহায়,শরীর ভেঙে গেলেও বেচেঁ থাকার অদম্য ইচ্ছা,আজ বাড়ী ফেরার সময় মায়ের পছন্দের কিছু নিয়ে যাবে, প্রতিদিন বাড়ী ফেরার সময় বউ,ছেলের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে কিন্তু কোনো দিন মায়ের পছন্দের কথা তার মনেই থাকে না।বিকাশ ঠিক করলো আজ বাড়ী ফেরার সময় মায়ের জন্য লাল দই কিনে নিয়ে যাবে,ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছে মা বরাবর লাল দই পছন্দ করে,আগে বাড়িতে লাল দই এলেই সে তার ভাগ শেষ করে ভাগ বসাতো মায়ের অংশে, স্নেহের চাদর মুড়িয়ে কোলে বসিয়ে প্রায় পুরো ভাগটাই মা তাকে খাইয়ে দিত,আজ কেজি খানেক লাল দই বাড়ী নিয়ে যাবে,নিজের হাতে খাইয়ে দেবে মাকে।ভাবতে ভাবতে কলেজে পৌঁছালো বিকাশ,আজও দেরী,আজও দু চারটা কথা শুনতে হবে তবে তাতে অসুবিধা নেই,মায়ের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা তার নেই,তবে মায়ের অসুস্থতার জন্য দেরী,দু চার কথা সে হজম করে নেবে।বাড়ী ফিরতে একটু দেরি হলো বিকাশের, সন্ধ্যে নেমেছে,তবে চারিদিকে তখন আবছা অন্ধকার,এক ভাঁড় দই কিনে বাড়ী ফিরে আসার সময় বিকাশ দেখলো উঠোনে লোকে লোকারণ্য, ভিড় সরিয়ে দেখলো উঠোনে সকলের মধ্যমণি হয়ে শুয়ে আছে মা,গলা শুকিয়েছে বিকাশের, মা উচ্চারণ করার ক্ষমতা তার নেই,শরীরের ভিতরের আর্তনাদ গুলো যেন আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে,জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্নায় যেন ফাঁকি দিয়েছে তাকে,সবাই যেন আঙুল দেখিয়ে বলছে তুমি তোমার মায়ের হত্যাকারী!,এক ঝটকায় মায়ের পাশে গিয়ে বসল বিকাশ,মায়ের মুখটা যেন একই রকম অসহায় ও দুর্বল,যেন বিকাশের কানে কানে বলছে"বাবু! আর ঔষধ আনতে হবে না,দেখ আমি ভালো হয়ে গেছি"।

যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

স্বীকারোক্তি


 

অনেক কিছুই তোমাকে বলা হয়ে গেছে

শেষ কিছু আর বাকি নেই হয়তো  

গোঁয়ার মোষের গুঁতোনিতে দিন আর রাতবালিশ কতবার ভিজল –

শুকোল, আবার ভিজল –

 

এবার মেঘলা দিন ছুটি দিয়ে সূর্যকে ডাকছি – বালিশ যেন খটখটে শুকনো থাকে।

পাখির ঠোঁটে পাঠিয়ে দিয়েছি সব মেঘলা দিনের স্যাঁতস্যাঁতে মনতোষক

 

যদিও গা ঘিনঘিনে বা উপেক্ষা বিষয়ে কোনো কড়চা বা সনদনামা দেওয়াল ফলকে

দস্তানা খুলে দেয়নি

তবু শুধু যৌনতা বিষয়ে জানলার ফোকর সম্বলিত বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের সাইক্লোরামা

জেগেছিল প্রবল

তাতে অন্ন ব্যঞ্জন সম্বন্ধীয় সদালাপের স্বরলিপি সাধা হয়নি,

আঠারোটা গিঁট ছিল জামাকাপড়ে

 

তথাপি তদগত –

এটুকুই জানানোর বাকি ছিল। 

বাকি সব কথাই হয়তো বলা হয়েছে তোমাকে

যাতে যথেষ্ট আলোহাওয়ার খেলা ছিল, শুধু তুমি পাল উড়িয়েছিলে কিনা

সে খবর জানা হয়নি কোনোদিন

 

ভজন দত্ত

কনসেনট্রেশান ক্যাম্প থেকে

 

করোটির ভিতর-ভিতর রোটির জন্য অহরহ

দেশের মানচিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে!

অহর্নিশ 'পাখি-পাখি' গালি খাচ্ছে  মানুষ!

এই তো বেশ ধর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে শরীর।

 

আড়মোড়া ভাঙলেই আগুন কিংবা মাটি!

থালাবাটিঘটিহাততালির আওয়াজে

আদর ও সমরে মেকি আর্দ্রতা থাকলেও,

আদরনীতি হয়নি এখনো!

 

বুঝিনি কবে,কখন,কীভাবে

গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের বাঁচননীতিতে

নিয়ত সংসারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে

অত্যাচারিত নিপিড়ীত হতে হতে

আমাদের ভালোবাসা কাঠ হয়ে গেছে...

শর্মিষ্ঠা ঘোষ

পরাজয় 

মুঠো ভরে নাও আবীর গুলাল রাগে

হৃদয়ে বসত চির অমলিন প্রেম

স্নেহ মায়া খুব আভিধানিকের কথা

চলতে ফিরতে মানুষেই আশ্রয়

কেউ তো বলে নি এটা গন্ডীর নয়

কেউ তো আঁকেনি সীমানা পেরনো মানা

কেউ কেউ যদি ভাবেও এমন হয়

ডানা জোড়া আরো শক্ত পোক্ত কর

যেখানে আড়াল যেখানে কষ্ট লেখা

চক ডাস্টার ব্ল্যাকবোর্ড ঠিক জানে

নতুন হরফে রক্ত ফুটিয়ে লেখা

একটা জীবন সার্থক বাঁচা মানে

একটা জীবন ঘষতে পুড়তে সোনা

পাথর আগুন জল জানে বরাভয়

ফোস্কা আসলে ত্বকের ওপর দেখা

তারও আছে কিছু প্রশ্রয়ী নিরাময়

ঠিক মানুষটি কোথাও অপেক্ষাতে

দেখাশোনা হলে ম্যাজিক যুদ্ধ জয়

তুমি লড়ে চল নির্ভয় নিঃসঙ্কোচ

জীবন মানেই মাঝে সাঝে পরাজয়

মৌসুমী দত্ত

সায়নীর সংসার

 


 

অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে, হঠাৎ সায়নীর ফোন বেজে উঠল। উপস্থিত সবাই খুব বিরক্ত। সায়নী কাঁচুমাচু মুখে,

", স্যার এক মিনিট প্লিজ"

বস সম্মতি দিয়ে মাথা ঝাঁকান।

অফিসে সায়নী সবচেয়ে বেশি এফিসিয়েন্ট, নিখুঁত পারফরম্যান্স ,ওর প্রতি বসের প্রছন্ন প্রশ্রয় থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

পরিমরি করে ফোন নিয়ে রুমের বাইরে আসে সায়নী। ফোনটা ওর শ্বশুরমশাইয়ের।

" হ্যালো বাপি বলো..."

""বৌমা, লাঞ্চের পর যেন কোন ওষুধ টা খাবো?""

" আমি মা কে বুঝিয়ে এসেছি তো। "

""ওই বেআক্কেলে ভদ্রমহিলার উপর আমার ভরসা নেই একটু ও।"

ওনার বলার ধরন দেখে হেসে ফেলে সায়নী।

"বাপী হলুদ ক্যাপসুল টা।"

"ও আচ্ছা আচ্ছা, তুমি কাজ করো, বিরক্ত করবো না।"

ফোনের ওপার থেকে শাশুড়িমার উচ্চস্বরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

'"কি মিলল কিনা? আমার কথা বিশ্বাস হয় নি তো।"

সায়নী তাড়াতাড়ি মিটিং রুমে ফিরে যায়।

 

সবে অফিস ছুটি হয়েছে , কয়েকটা মেইল চেক করেই সায়নী বাড়ি অভিমুখে রওনা দেবে, আবার ফোনটা বেজে উঠলো ......

এবার শাশুড়িমার," বৌমা এবেলা মালতী রান্না করতে আসবে না, এদিকে বুড়োটা বায়না করছে চিঁড়ের পোলাও খাবে... আমি ওসব পারবো না বলে দিলুম। দাদুভায়ের আমার কোনো বায়না নেই। এদিকে বুড়ো নোলা দেখো..."

.

""... মা তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমি সবার মনপসন্দ টিফিন কিনে নিয়ে ঢুকছি।""

"বাঁচালে আমাকে, যাই বুড়োকে গিয়ে বলি, খুশি হবে।"

 

এই নির্ভরতা গুলো সায়নী খুব উপভোগ করে।

আজ প্রায় আট বছর বিয়ে হয়েছে সায়নীর। পাপুন এবার সাতে পরবে।

বিয়ের আগে আগে ওর মায়ের যে কি ভয়..

" এই জেদী একগুঁয়ে মেয়ে কোন সংসারে যাবে?

মানিয়ে চলতে পারবে তো..."

সেই সায়নী যে কোন জাদুবলে সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী হয়ে বসলো , তা ভেবেই মা অবাক হয়ে যান।

 

তবে শ্বশুর মশায়ের রিটায়ারমেন্টের পর দাম্পত্য কলহ চরমসীমায় পৌঁছে গেছে।

সকাল- বিকাল , যখন, তখন তর্জন, গর্জন , গোলা-বারুদ বর্ষণ চলতেই থাকে।

 

"" ...ওফ, এই বুড়ো আমার জীবনটা একেবারে বটপাতার মতো করে দিল গো ..."

""বৌমা জিজ্ঞাসা করো তো কথায় কথায় যে আমাকে বুড়ো বলে , উনি কি নিজেকে কচি খুকি মনে করেন নাকি?""

কথাটা সত্যি, ওর শ্বশুরমশাই মাত্র তিন বছর রিটায়ার করেছেন। হাবে, ভাবে, চাল -চলনে মোটেই উনি বুড়ো নন। এই ভাবে ""বুড়ো বুড়ো' বলে ওনার আত্ম বিশ্বাসে আঘাত হানা ঠিক নয়।

 

আবার শাশুড়িমার জীবনের সাথে বট পাতার কি সাদৃশ্য সেটা ভেবেও কূল কিনারা পায় না সায়নী।

 

কিন্তু জিজ্ঞেস করাটা তো ঠিক হবে না, এটা শ্বশুরবাড়ি। আর ও হলো গিয়ে বিচারপতির আসনে, কাজ টা যে অসম্ভব কঠিন ...

প্রলয় মাঝে মাঝে বলে, কি ফর্মূলা ইউজ করো বলতো? বাদী-- বিবাদী উভয় পক্ষই বিচারকে রায় মেনে খুশি হয়ে কাজে ফিরে যান।

 

* * *

কিন্তু এই সায়নীর ওর বাপের বাড়িতে রূপ অন্য। বাবার প্রতি ওর একশো ভাগ দুর্বলতা আর পক্ষপাতিত্ব। আসলে বাবা মানুষটি বেশি ভালো, আর অত্যন্ত নিরীহ। শ্বশুরমশায়ের মতো লড়াকু নন। সব ক্ষেত্রেই উনি বিনা যুদ্ধে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন । সায়নী উপস্থিত থাকলে মায়ের তোপের বিরুদ্ধে পাল্টা তোপ দেগে বাবা কে জিতিয়ে দেয়।

মা ভীষণ শক্ত ধাঁচের বাস্তববাদী মানুষ, বরং বাবা আবেগে ভেসে যান।

সায়নীর বিয়ের পরদিন বিদায়বেলায় বাবার কি করুণ অবস্থা, একমাত্র কন্যা কে উনি যে চোখে হারান। পুরুষ মানুষ কে ওই ভাবে কেউ কোনো দিন কাঁদতে দেখে নি।

খালি বলে চলেছেন," আমি এক্কেবারে অসহায় হয়ে গেলাম। "

 

বাবা, মার কথা মনে হতেই ওর বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। মা আজ পা ভেঙে চার মাস হলো শয্যাশায়ী। পায়ে ছয় ইঞ্চির একটা প্লেট বসেছে। ডাক্তার বাবু বলেছেন, সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরো কিছুদিন লাগবে।

খবরটা পেয়ে পাপুনকে শাশুড়িমা কাছে রেখে ও ছুটে গেছিল। বাবার সাথে ছোটাছুটি করে মায়ের ডাক্তার দেখানো, এক্সরে , অপারেশনের সব ব্যবস্থা করেছে। প্রথম দিকে আয়া সেন্টার থেকে দিনে- রাতে দুবেলা আয়া এসে মায়ের দেখাশোনা করতো।

খাবার আসতো হোম সার্ভিস থেকে।

আয়া গুলো যেদিন লকডাউন হয়, সেদিন আসতে পারে না। মায়ের আবার সুগার, কোলোস্টোরল, ডাক্তারবাবু ডায়েট চার্টে একদম লাইট বয়েল ফুড লিখে দিয়েছেন। হোম সার্ভিসে সেরকম ডায়েটের ব্যবস্থা নেই। বাবার বাড়ি থেকে সায়নীর অফিস ঘন্টা খানেকের পথ। মায়ের দেখাশোনা, রান্না করে অফিস যেতে ওর খুব অসুবিধা হচ্ছিল।

সমস্যার সমাধান করলো ওর অফিসের কলিগ মিমি। একজন চব্বিশ ঘন্টার লোক ঠিক করে দিল । সারাদিন ওদের বাড়িতে থাকবে , খাবে , মায়ের দেখাশোনা সাথে সাথে ওনার জন্য রান্না টাও করে দেবে। অবশ্য ডায়েট চার্ট অনুযায়ী রান্না করে দেওয়ার জন্য ডবল চার্জ। তা হোক গিয়ে, মা তো তাড়াতাড়ি সুস্থ হোক । তাপসী নামে এই মাঝবয়সী মহিলা মিমির পিসিমাকে দেখাশোনা করে সুস্থ করে তুলেছে। মহিলা কে সায়নীর বেশ পছন্দ হলো। দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের স্যুপ রান্না শিখিয়ে , ডায়েট চার্ট ভালো করে বুঝিয়ে দিল।

এদিকে মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন,

'তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা, ও বাড়ি তো তোকে ছাড়া অচল। পাপুনকে টাও মা কে ছেড়ে এতোদিন আছে । প্রলয় মুখে রা কাটে না , তাই তো নিজের খুশি মতো চলতে পারিস। । ওর অফিসে চাপ তো কম নয়। এমন ভালো শ্বশুরবাড়ি অনেক ভাগ্য করে পেয়েছিস।

একপ্রকার ঠেলেঠুলে উনি সায়নীকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।

মা মানুষ টা এরকমই । দাঁতে দাঁত চেপে নিজে কষ্ট সহ্য করবে, সায়নীর দাম্পত্য আর সাংসারিক জীবনে যেন আঁচড় টি না লাগে।

 

মনে পরে , নতুন বিয়ের পর এক ছুটির দিনে মা, বাবা কে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিল সায়নী, সেদিন একা হাতে যত্ন করে সব পদ রান্না করেছিল। বাড়ি গিয়ে বাবার নাকি চোখে জল, আমার বাপ সোহাগী আদরের ম্যানেজমেন্ট পড়া মেয়েটাকে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হচ্ছে......

মা গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, ..."রান্না করলেই হাত পোড়ে না বুঝলে , হাত পোড়ে অসাবধানতায় । রান্না একটা শিল্পকলা, প্রত্যেক মানুষের শেখা উচিত । "

""...আমাদের কোচবিহারের রাজকন্যা , জয়পুরের রাজমাতা গায়ত্রী দেবী একজন রন্ধন পটিয়সী মহিলা ছিলেন ,জানো কি সেটা?..."

সায়নীর মা কোচবিহারের মেয়ে, এবার কোচবিহার প্রসঙ্গ এসে পরেছে, বাবা তাড়াতাড়ি মুখে সেলোটেপ আঁটেন।

 

আসলে মায়ের সায়নী কে ঘিরে অনেক স্বপ্ন। ও উচ্চশিক্ষিত, সুচাকুরে, নজরকাড়া সুন্দরী। মায়ের সব সময় ভয় এই গুণ গুলো যেন ওকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী , অহঙ্কারী করে ওর ব্যাক্তিগত জীবনে বিভ্রাটের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।

তাই তো সবসময়ই উনি ওকে আদর করে ঢুপসি',' অকম্মার ঢেঁকি ' বলে থাকেন।

 

আজ মায়ের জন্যে মনটা ভীষণ ছটফট করছে, পাপুনের ফাইনাল পরীক্ষা আর অফিসের কাজের চাপে দুসপ্তাহের বেশি ও বাড়ি যেতে পারে নি সায়নী। রবিবারে যাবে ভেবে ছিল কিন্তু ও দিন আবার শাশুড়িমার ডাক্তারের কাছে অ্যাপোন্টমেন্ট নেওয়া ছিল। উনি বারণ করা স্বত্তেও জোর করেই সাথে গেছে সায়নী কারণ ও সাথে থাকলে শাশুড়িমা খুব ভরসা পান।

 

প্রলয় অবশ্য এর মধ্যে একদিন গিয়ে ঘুরে এসেছে ওদের বাড়ি থেকে , বলল দারুণ কাজ করছে তাপসী। প্রলয় কে নাকি জামাইদাদাবাবু বলে খুব খাতির যত্ন করে লুচি , আলুর দম খাইয়েছে।

 

মন কেমন করাতে হঠাৎ ই অফিস থেকে হাফ সি এল নিয়ে বাড়ি ছোটে সায়নী। চমকে দেবে বলে চুপি চুপি আস্তে করে গেট খুলে ঘরে ঢোকে । বাহ্ ড্রইং রুম সুন্দর পরিপাটি, কুশন কভার গুলো নতুন, ফুলদানি তে ফুল সাজানো রয়েছে। দেখে তো ও অবাক। ডাইনিং হল থেকে কথার আওয়াজ আসছে, পা টিপে টিপে গিয়ে দেখে বাবা আর তাপসী একসাথে গুছিয়ে খেতে বসেছে।

মেনু তে রয়েছে লাল চিকেন কষা, মাছের ডিমের বড়া, পটলের দোলমা।

বাবা ওকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন। "আরে, তুই ..

খবর দিস নি তো।"

কেন বাপের বাড়িতে খবর না দিয়ে আসতে মানা নাকি?

'"কি সব যে বলছিস...নে খেতে বস।"

"আমার লাঞ্চ হয়ে গেছে। "

"মা কি খেল তাপসী দি? এসব রিচ রান্না তো মার চলবে না। "

তাপসী আমতা, আমতা করছে , উত্তর দিতে পারছে না।

" বাবা, এই পরিস্থিতিতে কুশন কভার গুলো কোথা থেকে আমদানি করলে?"

"ওই দক্ষিণাপণ, আসলে তাপ..... "

বাবা কে মাঝ পথে চুপ করিয়ে দিয়ে তাপসী বলে, "দিদি জানো ফুল আমার ভীষণ প্রিয়, তাই রোজ ..."

ওর কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সায়নী সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় যায় মায়ের ঘরে।

 

একি চেহারা হয়েছে মায়ের। চোখ দুটো গর্তে ঢোকানো, গালের হাড় বেড়িয়ে গেছে।

গায়ের ব্লাউজটা ঢিলা, পরনে বাসী কাপড়, স্নান করানো হয়নি। চুলগুলো জটাজাল। বিছানার চাদরটা নোংরা। টেবিলের উপর অগোছালো ভাবে ওষুধ গুলো উল্টে পরে আছে। এঁটো হরলিক্সের গ্লাসটা তে পিঁপড়ে ধরেছে।

ঘরের হতশ্রী অবস্থা দেখে ওর গা গুলিয়ে উঠলো।

মা ওকে দেখে হেসে বললেন, ""পাপুনকে আনতে পারলি না, কত দিন দেখিনি ওকে....

বেয়াই, বেয়ান ভালো আছেন? এবার তো জামাইষষ্ঠী হলো না....""

চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে মায়ের চুল গুলো বেঁধে দেয় সায়নী।

""আমি তো বললুম জামাইষষ্ঠী আমি করবো, শুনলে না তো। "

চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখে তাপসী কখন সায়নীর জন্য এক কাপ গরম কফি নিয়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

""জানো দিদি মাসিমা কে কত করে বললাম চাদর খানা পাল্টে দি, মাথা আঁচড়ে দি, শুনলেই না, উল্টে রাগ দেখালো। "

সায়নী অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ---"মাসিমা কে?"

"কেন ? তোমার মা। "

"কিন্তু বাবা কে তো তুমি দাদা বলছো শুনলাম। "

"বাই দ্য ওয়ে, কফিটা ভালো হয়েছে। "

 

তাপসী উচ্ছাসে ফেটে পরে , 'জামাইদাদাবাবু ও আমার রান্নার প্রশংসা করেছে।"

 

মার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, নির্বাক দুচোখে অদ্ভুত শীতলতা, ঠোঁট দুটো অসম্ভব শুকনো। ভিতরে , ভিতরে সায়নীর বুকটা ফেটে যাচ্ছে । মায়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে , গালে একটা চুমু খেয়ে সায়নী বেড়িয়ে আসে।

তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে, বেশি দেরি করলে সাংঘাতিক জ্যামে আটকে পরবে। তাছাড়া এখানে থাকতে ওর ভালো লাগছে না।

 

বাবা পিছন পিছন আসেন, "কবে আসবি আবার? এবার তো অনেক দিন পর এলি।"

তাপসী বলে, ""দিদি ফোন করে এসো, সুবিধা হয় তাহলে...."

ওর আস্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যায় সায়নী।

 

বাড়ি ফিরে সায়নী ভীষণ আনমনা , চুপচাপ । ব্যাপারটা প্রলয়ের নজর এড়ায় না। ওকে একান্ত ভাবে কাছে টেনে নেয় ..

কি হয়েছে তোমার? আমায় বলবে না? মাকে নিয়ে এতো চিন্তা করছো ?

""আমি তো দেখে এসেছি, সবই সুষ্ঠ ভাবে চলছে... তাপসী দারুণ সার্ভিস দিচ্ছে। "

সায়নী এক দৃষ্টি তে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে,

মনে মনে বলে...., 'হায় রে পুরুষ, সবই যদি তোমার দৃষ্টিগোচর হবে ......তবে গর্ভধারণ ক্ষমতা ভগবান শুধু নারী কেই দেবে কেন? "

* * *

পরদিন সক্কাল সক্কাল কলেজের বন্ধু রিয়ার ফোন,

চাকরি তে প্রমোশন আর বার্থ ডে,

সেই উপলক্ষে ওদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যায় সায়নী- প্রলয়ের নিমন্ত্রণ। প্রলয় যেতে পারবে না, অফিসে প্রচুর চাপ , ওদের কম্পানির একটা নিউ প্রডাক্ট মার্কেটে লঞ্চ করবে, অগত্যা সায়নী একাই....

ফোনে মনিকা আর পাপড়ি র সাথে কথা বলে প্ল্যান করে নেয়, সব বান্ধবীরা বর ছাড়া একাই যাবে রিয়ার বার্থ ডে তে, চুটিয়ে মজা করবে।

 

রিয়া দের বাড়ি ওর বাবার বাড়ির পাড়াতেই। রিয়া, মানসী, সায়নী, পাপড়ি সব কটা একসাথে কলেজে পড়েছে।

সায়নী একটা বড় ঢাউস ব্যাগ নিয়ে সকাল সাড়ে নটায় বাবার বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। ড্রইং রুমে সোফায় বসে বাবা মিহির বাবু জোরে জোরে আজকের " আনন্দ বাজার " পড়ছেন। তাই শুনে তাপসী দুলে দুলে হেসে যাচ্ছে। আজকের 'আনন্দ বাজার ' সকালে চোখে বুলিয়ে এসেছে সায়নী, হেসে গড়িয়ে পরার মতো কোনো খবর ছাপা হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।

সায়নী হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে।

"এই ব্যাগটা আমার উপরের ঘরে রেখে আসো তো তাপসী দি।'

''এর মধ্যে শাড়ি কসমেটিক্স আছে। "

""বাবা আজ রিয়ার জন্মদিন, এখান থেকে রেডি হয়ে যাবো ওদের বাড়ি, আজ রাতে এখানে থাকবো। কাল এখান থেকে অফিস। এসব লোটাকম্বল নিয়ে তো আর অফিস যাওয়া যায় না, তাই জামাকাপড়ের ব্যাগটা এবেলা রাখতে এসেছি।"

এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে সায়নী হাঁপাতে থাকে।

"আরে তুই তো হাঁপাচ্ছিস, বস একটু, কিছু মুখে দে।"

:""না না একদম না। আই অ্যম অলরেডি লেট। আজই একটা প্রোজেক্ট কমপ্লিট করতে হবে।

মার সাথে এখন আর দেখা করছি না, বলে দিও, রাতে তো থাকবোই।

বাই বাই "।

 

যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল সায়নী, তেমনি ঝড়ে র গতিতে বেড়িয়ে যায়।

কাজ পাগল মেয়ের আচরণ দেখে মনে মনে গর্বিত বোধ করেন মিহিরবাবু।

 

সন্ধ্যার একটু আগে এক গুচ্ছ জুঁই ফুলের মালা আর সুদৃশ্য প্যাকেটে মোড়া গিফ্ট নিয়ে ঘরে ঢোকে সায়নী।

ওর পিঙ্ক -গ্রীন কম্বিনেশনের কাঞ্জিভরম শাড়ি টার সাথে খোঁপায় সাদা জুঁই ফুল দারুণ মানাবে।

তাপসী দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বলে , "দিদি আমাকে ফুলের মালা দেবে?

মাথায় লাগাবো।"

বাবা চাপা স্বরে ওর কাছে এসে বলেন, " বেশি থাকলে একগোছা দে ওকে, গরীব মানুষ সখ হয়েছে। "

সায়নী এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে," মালা গুলো তুমিই রাখো তাপসী দি, আমি ভাবছি ওয়েস্টার্ন হেয়ার স্টাইল করবো"।

বাবা বললেন ..

"সেটা আবার কি রকম? "

"ওতে ফুল, টুল মানায় না।"

ও আড় চোখে লক্ষ্য করছে বাবা মুখে খুশি উপচে পরছে।

বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না সায়নী। নিজের ঘরে চলে যায় । পাপড়িদের টাইম দেওয়া আছে। চটপট রেডি হতে হবে।

কয়েক মিনিট পরেই সায়নীর গলা ফাটিয়ে চিৎকার, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না।

সব্বাই ছুটে এসেছে , মা কোনো রকমে দেওয়াল ধরে , ধরে এক পায়ে লেংচে, লেংচে ক্রাচ নিয়ে হাঁচড়- পাঁচড় করে পাশের ঘর থেকে সায়নীর ঘরে এসেছেন।

তাপসী খোঁপায় ফুলের মালা জরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাবা চমকে গেছেন।

সারা ঘরের চতুর্দিকে জামা, কাপড় , লিপস্টিক, আই পেনসিল, মেকআপ কিট গড়াগড়ি খাচ্ছে।

সায়নীর অত সাধের কাঞ্জিভরম শাড়িটা ফালা ফালা করে কাটা।

মা বললেন, এই শাড়ি টা তো তোকে প্রলয় এ বছর অ্যানিভারসারি তে গিফ্ট করেছে। কত ছবি এটা পরে । এটার এ অবস্থা কে করলো? কত দামী শাড়ি।

মিহির বাবুর কপাল ভাঁজ, কাজের মাসি কোন সকালে ঘরদোর সাফ করে চলে গেছে, সেই তুই আসার আগে । তারপর তো বাইরের কেউ আর আসে নি।

 

এদিকে সায়নী কারোর কথা শুনছে না। হাত , পা ছড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে সেই স্কুল ছাত্রীর মতো কেঁদে চলেছে।

ভীষণ রাগ দেখিয়ে " এই বাড়ি তে আমার একটা শাড়ির নিরাপত্তা নেই?

আবার পাপুনকে নিয়ে আসবো?

কোনো অধিকার বা অস্তিত্ব আছে নাকি আমার?

একটা নো এন্ট্রি বোর্ড টাঙিয়ে দিলেই তো হতো,

আমি আসা তে অসুবিধে হচ্ছে ,ভালো লাগছে না সেটা বুঝেছি।

তাই বলে প্রলয়ের গিফ্ট করা এতো দামী শাড়ি টা ছিঁড়ে দেবে?"

মিহির বাবু...."" মা তুই এসব কি বলছিস, এটা তোর বাড়ি । মাথা গরম করিস না...""

মায়ের কোনো শাড়ি পরে রিয়ার বাড়ি যা, আমি দেখছি তারপর, কি করে এসব হলো...."

সায়নী এসব কথা গ্রাহ্য করলো না, কোনো রকমে জিন্স, টপ গলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুমদাম পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 

মিহির বাবু মেয়ের পিছন পিছন দৌড়ালেন," এই এই কোথায় যাচ্ছিস? শোন , শোন..

বিয়াই, বেয়ান কি ভাববেন?

তোর আজ এখানে থাকার কথা।""

 

সায়নী চোখ মুছতে মুছতে ঠোঁট ফুলিয়ে ,

" আমি অনাথ, আমার কেউ নেই।

"বাই ফর এভার । "

বলে গট গট করে বেড়িয়ে যায়।

* * *

পরদিন ভোর ছয়টায় সায়নীর ফোন টা বেজে উঠল। গতকাল অনেক রাতে দুটো সলিডন আর একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ও ঘুমোতে গেছে। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল, বাবার অসহায় করুণ মুখটা বার বার মনে পরাতে দুচোখে জল বাঁধ মানছিল না।

ঘুম জড়ানো গলায় ফোন টা ধরে ও। ফোনের ও প্রান্তে মা,

""এই মামনি , আর রাগ করে বসে থাকিস না। আজ একবারটি এ বাড়ি আয়।

কাল তক্ষুনি দু মাসের মাইনে দিয়ে তাপসী কে বিদেয় করেছে তোর বাবা।

মানুষটা খুব আঘাত পেয়েছেন, অনুতাপে ভুগছেন। কাল সারারাত ব্যালকনিতে চুপটি করে বসে ছিলেন, শেষে উনি অসুস্থ না হয়ে পরেন। "

ফোন রেখে আনন্দে এক লাফে খাট থেকে নীচে নামে সায়নী।

 

""ইয়ায়াহ হু হু হু ।

আই ওন দ্য গেম। ""

 

ভারি তো একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি.......

প্রলয়ের কাছে বায়না করে ও আর একটা কিনে নেবে।

মা আজ তোমার সায়নী নিরপেক্ষ বিচারক।

ও ফোন টা হাতে তুলে ডায়াল করে,

''হ্যালো, আয়া সেন্টার ........"

 

 

 

 

সাইফুল্লা তরফদার

বদল নয় বদলা চাই

 

পথে মুমূর্ষু কেউ দেখলে আমি, ঘুরিয়ে চোখ রাস্তা পাল্টাই;

রক্ত আমার সহ্য হয় না মোটে, তাই ওসব যে ভাই এড়াই,

পাশের বাড়ি হলে মারামারি, ভয়ে আমি খিড়কি লাগাই;

ভাই-ভাই -এ লাগলে লড়াই, বাড়িতেই বসে আমি চৌকি বাজাই।

 

দাঙ্গা হাঙ্গামা দেখলে যে ভাই, পিলে আমার চমকায়,

আমিই আবার পেলেই সুযোগ দাঙ্গাতে লোক উসকাই।

ধর্ষিতার চিত্কার শুনে আমি কানে তুলো গুঁজে পালাই,

প্রত্যক্ষ দর্শী হয়ে সাক্ষী দেওয়ার কথা শুনে,হাঁটু আমি কাঁপাই।।

 

আমি রোজ জোর গালি পাড়ি সম্পদ অসম বাটা'য়।

অভাবে চায় যদি কেউ কিছু,দিতে মোর জান যাই যাই।

সামাজিক কোনো কাজেই যেতে আমি পাই না সময়,

অথচ গলা ছেড়ে বলি আমি ওরা ভন্ড ছাড়া কি!যারা সেবায় সমর্পিত স্বেচ্ছায়।

 

গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিই আমি, পরিষেবা ঠিক ঠাক না মেলা'য়;

আমি মাঝে মাঝেই নেতাদের খিস্তিয়ে নির্বাসনে পাঠাই।

আবার নেতা দেখলেই আমি, ছুটে গিয়ে সঙ্গে আছি বোঝায়,

আমি রং ঢং বুঝি না যে ভাই,সোজা কথা হাওয়া বুঝে নিজেকে ঝোলায়।

 

বলি আমি সহজেই,যার বাবা আছে ঢের,সে তো বিকাতেই পারে সস্তা'য়,

আমি তো বাবা সারাদিন ঘুরি রাস্তায়,খুঁজি সুখ শুধু যে টাকার বস্তা'য়।

 

আমি রাজনীতি বুঝি না মোটে,আমি ভাই ওসবের সাতে পাঁচে নাই,

শুধু লাগলেই যুদ্ধ, হঠাত্‍ করেই দেশ ভক্তি আমার চাগা'য়।

আমি ঘরে বসে'ই শুধু দেখাই দমক,সামনেতে গেলে সব ফুরায়।

আমি সুযোগ পেলেই,ফোড়ন মেরে ওদের বোঝাই,

উথলেছে মোর দেশ দরদ আজ, দেখবি তোরা আয়;

গর্জে উঠে বোঝাতে চাই,

আপস নয় চুক্তি নয়-

বদল নয় বদলা চাই।।

 

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...