সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

ব্যুমেরাং

 

 

 মালঞ্চ আবাসনের ডি ব্লকের সামনে সকাল ছটায় দুটি ম্যাটাডোর এসে দাঁড়াল। ঝটপট ছয়জন ম্যাটাডোর থেকে প্যাক করা জিনিসপত্র নামিয়ে দোতলায় তুলতে লাগল।ওই ফ্লোরের খালি থাকা একটি মাত্র ফ্ল্যাটের চাবি খুলে মালপত্র ঢোকাতে শুরু করল মেশিনের মত।অপর তিন ফ্ল্যাটের থ্রি মাস্কেটিয়র্স রমলা,শীলা আর সুতপা তখন মর্ণিং ওয়াক ক'রে ফিরছিল। তিনজনের বয়স চল্লিশের আশেপাশে।বেশ হাঁপাচ্ছে তিন গৃহবধূ। জানুয়ারী র এক তারিখে তিনজনে একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছে,যে করেই হোক ভ্যালেন্টাইন ডের আগে তারা স্লিম হবেই।যে যার হাবিকে নিয়ে ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম আর হো,আ্যপ গ্রুপে ছবি দিয়ে এক্কেবারে সক্কলের চক্ষু ছানাবড়া করে দেবে।উফফ,হিংসায় সব দম আটকে হাঁসফাঁস করবে।সেই গোপন মিশন সাকসেসফুল করতেই সেদ্ধ সবজি,ফলমূল এবং প্রভূত পরিমাণ স্যালাড পাঁচন গেলার  মত মুখ ক'রে খাওয়ার পরও প্রাতঃকালে ট্রাক স্যুট এবং স্নিকার পরিহিত হয়ে ঘন্টাখানেক চক্কর দিতে হচ্ছে তিনজনকে।রমলা বরকে ধমক দিয়ে একখানি ওজন মাপার ইলেকট্রনিক যন্ত্র এনেছে।তাতে তিনজনেই দিন পনের কৃচ্ছসাধনের পর মেপে দেখেছে পাঁচশ গ্রাম মত গড়ে কমেছে।তারা এবার জিমে যাবে কিনা ,তাই নিয়ে প্রভূত আলোচনা করতে করতেই ভ্রমণ করছিল।তাই হাঁপানি টা আজ একটু বেশিই।

 

----বাবা!এদ্দিনে তাহলে এই ফ্ল্যাটে কেউ আসবে।

রমলা গলার ঘাম কালো হয়ে আসা হলুদ রুমালে মুছে বলে।

 

---কেমন লোক হয় সব,কে জানে?

নরম সরম শীলা গলা শুকিয়ে যাওয়া গলায় বলে।

 

---আমাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলেই হ'লো।

সুতপা তার টনটনে কোমরে হাত বুলাতে বুলাতে বল।

 

তিনজনেই চাবি খুলে ঘরে ঢোক,কারণ তিনজনের বর এবং একটি ক'রে সবেধন নীলমণিরা এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন।রমলার মেয়ে,বাকি দুজনের ছেলে।

 

 বরেদের অফিস এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে, কাজের লোক,রান্নার লোকের তদারকি ক'রে তিন বন্ধু প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে রমলার দরজার বাইরে জড়ো হয়।শীলা,আর সুতপার থেকে রমলা বড়ো বলে ওরা দুজন রমলাদি বলেই ডাকে।

 

নাহ, মালপত্র ঢুকিয়ে আবার দরজা লক করে দিয়ে লোকজন চলে গেছে।এর মধ্যে কেউ যে আসেনি,তা ওরা বিলক্ষণ জানে,কারণ তারা তিনজন দরজা হাটখোলা করেই রেখে দিয়েছে সকাল থেকে।বরেদের বিরক্তি কেয়ারই করেনি।এবং‌ কান ক'রে রেখেছে খরগোশের মতই খাড়া।

 

--হ্যাঁ গো,রমলাদি,যার ফ্ল্যাট ,তার পাত্তা নেই। এদিকে মালপত্র ঢুকে গেল!সুতপার গলায় বিস্ময়।

 

রমলা বেশ রহস্য নিয়ে বলে,'বোধহয় ব্যাচেলর কোনো ছেলে আসবে।'

 

সূতপা কাউন্টার করে,' কেন? একা ব্যাচেলর মেয়েও তো হতে পারে,আজকাল মেয়েরাও সব একা একা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে'

 

' আচ্ছা,ব্যাচেলরই বা বলছ কেন?ফ্যামিলিও তো হতে পারে!শীলা অনুচ্চ স্বরে বলে।

 

রমলা গমগমিয়ে বলে,' ফ্যামিলি হলে অন্য লোকের সঙ্গে মালপত্র পাঠায়?একজনও কেউ সঙ্গে আসবে না?তোরা হলে নিশ্চিন্তে ছাড়তিস এমন করে?

 

সুতপা আর শীলা একসঙ্গে বলে ওঠে,' সত্যিইই রমলাদি তুমি জিনিয়াস'

 

খুনখুনে হাসি হাসে রমলা।সেই হাসির সঙ্গে সঙ্গে জুতোর খুটখুট আওয়াজ শোনা যায়।ছয়জোড়া চোখ সিঁড়ির দিকে।কে লিফট ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে!

আবির্ভূত হন এক ঘনঘোর শ্যামল গাত্রবর্ণের তরুণী।বয়েজ কাট চুল।বাদামী আর কালো মেশানো চোখের মণি।জিন্স আর ধবধবে শার্ট পরা হিলহিলে শরীর।ওদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হেসে চাবি দিয়ে লক খুলে স্তম্ভিত তিন মূর্তিকে পিছনে রেখে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ ক'রে দেয় সে তরুণী।

 সাতদিন পরও রমলার উর্বর মস্তিষ্ক অনুধাবন করতে পারেনা, মেয়েটির সম্বন্ধে কোনো কিছুই।

দেখা হলেই কিন্তু হাসে মেয়েটি। ঝকঝকে চোখও হাসে। বারান্দায় পরিপাটি , পরিস্কার জামা কাপড় মেলা থাকে ।ও‌বাবা! শৌখিন টবে বেশ কিছু গাছও আছে।রমলার পাশাপাশি বারান্দা থেকেই দেখা যায়।না কোনো কাজের লোক আসে,না হোম ডেলিভারি ।,না খাবার,না অন্য কোনোকিছুই।সকাল আটটায় বের হয়,রাত আটটায় ফেরে।সব কাজ কি মেয়েটাই করে!

 

তিনবন্ধু সন্ধ্যায় প্রায় দিনই বসে বিফল হৃদয়ে, চিপস , চানাচুর বা পকোড়া  আর কফি সহযোগে পালা ক'রে এক এক জনের ড্রইংরুমে। তিনজনের মেদ ঝরানোর কঠিন প্রতিজ্ঞা ভেসে গেছে 'অলকানন্দা জলে'। মাঝরাত অবধি আবার তিনজনের মোবাইলে সবুজ আলো জ্বলে। আতিপাতি খোঁজে মেয়েটির মুখ।নামটা জানলে ফেসবুকে খুঁজে বের করা সহজ হ'তো।ভোরে আর কেউ উঠতেই পারেনা।মর্ণিং ওয়াক চুলোর দোরে।ওয়েট মেশিনে ধুলো জমে।

 

 ---কি করে বলোতো মেয়েটা?

 

----কে জানে রে শীলা, আচ্ছা! ভুলভাল কাজ করে না  তো?

 

মানে?কি বলতে চাইছ?

 

---বুঝতে পারছিস না!রমলাদি চোখ নাচিয়ে ইশারায় বোঝায়।

 

----কি বলছ রমলাদি !যাহ

 

---না,হতেও তো পারে,সুতপা।

 

--তাহলে রোজ সন্ধ্যা রাত্তিরেই ফিরে আসে?

 

--কিছুই জানিস না তোরা,আজকাল‌ কর্পোরেট দুনিয়ায় এসব দিনের বেলাতেই হয়।

 

---দেখতে তো মোটেই ভালো নয় রমলাদি।হাড়গিলে,কালো।

 

---কতজন এইসব মেয়েদেরই পছন্দ করে তা জানিস সুতপা?সব বিকৃত মনস্ক সুতপা।

 

--ধুসস,না না, একজনের সম্বন্ধে না জেনে শুনেই এসব বলা ঠিক নয় রমলাদি।

 

---কিছু গোপন ব্যাপারই  যদি না থাকবে,তাহলে কথা বলেনা কেন!খালি হাসে।আর এই রূপবতীকে  কোন ছেলে বিয়ে করবে বাপু!

 

---যা বলেছ রমলাদি,আগে তো দেখনদারি পিছে গুণ বিচারি।

 

--আমরাও তো ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনা রমলাদি।শীলা রিনরিনে গলায় বলে।

 

--এমন হেসে দ্রুত চলে যায়,থতমত খেয়ে যাই।দেমাক বড্ড।ওই ছিরি নিয়ে কিসের যে এত দেমাক কে জানে! একটা কাজের লোক রাখারও তো মুরোদ নেই।

 

এমন বার্তালাপ চলতেই থাকে তিন হরিহর আত্মার। তাদের খাবার হজম হয় না।ঘুম হয়না।বরেদের সঙ্গে খিটিরমিটির লাগে অকারণে।ছানাদের ধমক দেয় যখন তখন।বাড়িঘর অপরিচ্ছন্ন।চোখের কোলে কালি। হাসি উধাও।জীবন দুর্বিষহ।

 

এভাবেই কাটায় তারা,চিরতার জলের মতই।এমন এক কোনো  বিবর্ণ ভোরবেলায় রমলা

গায়ে পাতলা চাদর মুড়ি দিয়ে বারান্দায় সকালের নরম রোদে দাঁড়াতেই পাশের বারান্দায় হঠাৎ এক কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে ।চকিতে তাকিয়ে দেখে,সুঠাম,গৌরবর্ণ,

মাথা ভরা ঘন কোঁকড়ানো চুলের

  এক যুবক পাশের বারান্দায়!!ভরাট,আদুরে গলায় ডাকছে,'সু,, সু,,বারান্দায় চা নিয়ে এসো।'

 

উড়ন্ত পাখির মত উড়ে এলো বারান্দায় কাজল কালো মেয়েটি।চায়ের ট্রে রাখতে রাখতে রমলাকে দেখে সেই ঝকঝকে হাসিটি হেসে হাত নাড়ে,'হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে আন্টি।'

কী সুরেলা কন্ঠস্বর!

 

হতভম্ব রমলাকে ভালো ক'রে দেখে যুবক টি বলে,'আমি প্রতীক। সু,,মানে সুনয়নার বর।ট্যুর থেকে হঠাৎ করেই ফিরেছি কাল রাতে, সারপ্রাইজ দিলাম সু কে।ভালো করিনি,বলুন?আজ সু ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে।আজ আমরা পার্টি দেব সন্ধ্যায়। আসবেন আন্টি।

 

বলতে বলতে প্রতীক কাছে টানে সুনয়নাকে।

 

----প্রতীক, ওনার আরো দুজন বন্ধু আছেন'

 

---আমি সকলকে বলে আসব,পুরো ফ্যামিলি নিয়ে সক্কলে আসবেন।সু আর আমি দুইজনেই কিন্তু খুবই ভালো রান্না করি'

 

রমলার এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না,ছেলেটি উচ্ছল।মেয়েটি অন্তর্মুখী।

 

রমলা কোনরকমে বলে,'আসব'।

 

ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে রমলা।ফোন হাতে নেয়।শীলা,সুতপাকে জানাতে হবে।

নাহ,ভ্যালেন্টাইন ডে তে তাদের প্রতিজ্ঞা ‌পূরণ হ'লো না।সামনে কোন বিশেষ দিন আছে  কিনা দেখতে হবে।

 

রোদ্দুর হেসে লুটোপুটি খায় ঘর বারান্দায়।

 

1 টি মন্তব্য:

  1. অপূর্ব ছাড়া কি ই বা বলতে পারি। কি সুন্দর করে তুলে ধরেছ ম্লান মানসিকতাগুলি।

    উত্তরমুছুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...