সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১

স্বর্ণব দত্ত

২১শে ফেব্রুয়ারী



কন্ট্রাক্টরের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো বিকাশের,ভীড় বাস,বেলা তখন বারোটা ,"ভাড়াটা মিটিয়ে ঘুমোতে পারেন তো দাদা! বলেহারি ঘুম আপনার,বেলা বারোটা সময় এতো ঘুম!", কন্ট্রাক্টরের কথায় আশেপাশের লোকজনও মুচকি হাসলো, কারোর কথাই কর্ণপাত না করে ভাড়া মিটিয়ে দিল বিকাশ,মনে মনে ভাবল সত্যিই তো বারোটা সময় কেউ ঘুমায়?,সব তার কপাল! এই তো কথা শোনা শুরু , কাজে আজও দেরী করেই পৌঁছাবে সেইখানেও কথা শুনতে হবে,রোজ রোজ কথা শুনে এখন আর গায়ে লাগে না তার,নিদ্রাহীন রাতের গল্প প্রতিদিন আর কত শোনাবে সবাইকে, সবাই ঠাট্টা করে,। দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে বের করে,খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় হরপে লেখা ,"২১শে, ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস",মায়ের কথা মনে পড়ে যায় বিকাশের,তার এই অবস্থার জন্য দায়ী তার মা,বছর দুয়েক হল মা অসুস্থ,কি যে রোগ কেউ জানে না,বার বার ডাক্তার পরিবর্তন, ঔষধ পরিবর্তন করেও লাভের লাভ কিছু হয় নি,মনে মনে অনুতাপে ভোগে সে,তবে আজ মায়ের সাথে ব্যাবহারটা ভালো করে নি সে,মা যেন সেরে উঠছে না,কেমন যেন বাতিকগ্ৰস্ত হয়ে উঠেছে মা, আগে এমন ছিল না, ডাক্তার বলে দিয়েছেন কোনো রোগ নেই ,সব মনের রোগ,এবার পাগলের ডাক্তার দেখাতে হবে তাকে,বেসরকারি অফিসের দারোয়ানের কাজ করে কটা টাকা বা তার আসে তার মধ্যে মায়ের পিছনে এত খরচ করে পেরে উঠছে না সে,টান পড়ছে সংসারে,ছেলেটার দিকে নজর দিতে পারছে না সে,তোমার মায়ের রোগ কোনো দিন ঠিক হবে না,আমি কি কিছু বুজি না বাপু সব কাজ না করার ধান্দা আর টাকার ধ্বংস ,ওর জন্য আমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে",- বেনুর কথা গুলো গায়ে ছ্যাকা দিয়ে ওঠে বিকাশের,কিছু বলে উঠতে পরে না সে।আজ সব সহ্য না করতে পেরে মাকে অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছে সে,উত্তর সে পেয়েছে তবে মুখের কথায় নয়,মায়ের মুখের ভঙ্গিমা সব উত্তর দিয়েছে তাকে,চোখে অশ্রু ধারায় অসহায় মা বিকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ,"বাবু, শেষবারের মতো ঔষধ গুলো এনে দিই,দেখবি এবার আমি ঠিক হয়ে যাবো", মায়ের সেই মুখটা মনে পড়ে গেলে বুকটা কেঁপে ওঠে বিকাশের, ঝাপসা হয়ে আসা চোখে অতীতের কথা মনে পড়ে বিকাশের এর আগেও এত টানাটানির সংসারে মা তো বিকাশ অসুস্থ হলে এইরকম ব্যবহার করে নি, মায়ের উপর মায়া হয় বিকাশের,দু চোখ ভরে জল আসে তার,মা যেন প্রথম থেকেই অসহায়,শরীর ভেঙে গেলেও বেচেঁ থাকার অদম্য ইচ্ছা,আজ বাড়ী ফেরার সময় মায়ের পছন্দের কিছু নিয়ে যাবে, প্রতিদিন বাড়ী ফেরার সময় বউ,ছেলের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে কিন্তু কোনো দিন মায়ের পছন্দের কথা তার মনেই থাকে না।বিকাশ ঠিক করলো আজ বাড়ী ফেরার সময় মায়ের জন্য লাল দই কিনে নিয়ে যাবে,ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছে মা বরাবর লাল দই পছন্দ করে,আগে বাড়িতে লাল দই এলেই সে তার ভাগ শেষ করে ভাগ বসাতো মায়ের অংশে, স্নেহের চাদর মুড়িয়ে কোলে বসিয়ে প্রায় পুরো ভাগটাই মা তাকে খাইয়ে দিত,আজ কেজি খানেক লাল দই বাড়ী নিয়ে যাবে,নিজের হাতে খাইয়ে দেবে মাকে।ভাবতে ভাবতে কলেজে পৌঁছালো বিকাশ,আজও দেরী,আজও দু চারটা কথা শুনতে হবে তবে তাতে অসুবিধা নেই,মায়ের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা তার নেই,তবে মায়ের অসুস্থতার জন্য দেরী,দু চার কথা সে হজম করে নেবে।বাড়ী ফিরতে একটু দেরি হলো বিকাশের, সন্ধ্যে নেমেছে,তবে চারিদিকে তখন আবছা অন্ধকার,এক ভাঁড় দই কিনে বাড়ী ফিরে আসার সময় বিকাশ দেখলো উঠোনে লোকে লোকারণ্য, ভিড় সরিয়ে দেখলো উঠোনে সকলের মধ্যমণি হয়ে শুয়ে আছে মা,গলা শুকিয়েছে বিকাশের, মা উচ্চারণ করার ক্ষমতা তার নেই,শরীরের ভিতরের আর্তনাদ গুলো যেন আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে,জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্নায় যেন ফাঁকি দিয়েছে তাকে,সবাই যেন আঙুল দেখিয়ে বলছে তুমি তোমার মায়ের হত্যাকারী!,এক ঝটকায় মায়ের পাশে গিয়ে বসল বিকাশ,মায়ের মুখটা যেন একই রকম অসহায় ও দুর্বল,যেন বিকাশের কানে কানে বলছে"বাবু! আর ঔষধ আনতে হবে না,দেখ আমি ভালো হয়ে গেছি"।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...