শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

সম্পাদকের কলমে







মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর এক প্রান্তে দিন, অন্য প্রান্তে রাত্রির মতই এক দিকে আনন্দের উচ্ছ্বাস আর অন্য দিকে শোকের কালো কাপড় জড়িয়ে চলার নামই জীবন। ঋতু বদল হয় রোজনামচার খাতায়। যাই যাই করেও বারবার ফিরে তাকিয়ে, নাকের জলে-চোখের জলে পরিপার্শ্ব ভিজিয়ে, ভয়ানক অনিচ্ছায় শীত কিছুতেই যেতেই চাইছিল না। আর বসন্তও তার লাজুক স্বভাবের পেটেন্ট নেওয়া লালিত্য ছেড়ে ঠেলেঠুলে শীতকে তাড়িয়েও ঢুকে তার নির্ধারিত সময়ে মৌরসীপাট্টা গড়ে তুলতে পারছিল না। তবুও সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, যেতে হয় সবাইকেই একদিন। ব্রহ্মান্ডের এই সারসত্য মেনে নিয়েই টুক করে মিষ্টি রোদটা লাফিয়ে পড়লো ধানমাঠের ভিজে ভিজে আলে, শহরের রোমান্টিক পাইথন রঙা রাজপথের পিঠে। আর অমনি তাকে খপ করে ধরে ওই উঁচু শপিংমলের আয়না জানলা ঠিকরে ছুঁড়ে ফেললো মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়া সারা বছর কুঁকড়ে মুকড়ে থাকা মানুষগুলোর মাঝে। কান্ড দেখে সদ্য ঘুম ভাঙা পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া ফিকফিক করে মুচকি হেসে বাসন্তিক শো এর জন্যে তৈরী হতে শুরু করলো। উছলে লাফিয়ে উঠলো ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ির ক্ষুদের দল, মাটির বাড়ির ক্ষুদের দল, সামনের সানাই এর প্রতীক্ষায় থাকা লাল-সবুজ জীবন্ত বসন্তের দল। ওদের যে আপাত পরীক্ষা শেষ। খুব বড়দের ধারেকাছে সেই রোদ্দুর ঘেঁষে না। ওদের যে ইচ্ছে করলেই, দেখা হলেই ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। ওদের যে বসন্তের উচ্ছলতার মাঝেও হিসেব নিকেশ শেষ হয়না। তাই বলে কি রোদ্দুরের মনখারাপ হয়না? হয় বৈকি, তারও মনখারাপ হয়। যে ছেলেটা কোনোদিন নিজের খালি গা ঢাকতে পারেনি একটাও নতুন জামায়, যে মেয়েটা শুধুমাত্র একটু বিশ্বাসের ভুলে বিক্ষত শরীর নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, যে লোকটার দাদন শোধ হয়নি বলে নবান্ন হয়নি কিম্বা অপ্রতিরোধ্য ক্ষয় নিয়েও যাকে রোজকার বোঝা মাথায় তুলে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যেতে হয়, তাদের জন্যে চিকচিক করে তারও চোখের কোল। তখন আকাশে কালো হয়ে আসে মেঘ। রাগে নিস্ পিস্ করতে করতে একসময় হা হা শব্দে হেসে উঠে পাগলের মত মাথা নাড়তে শুরু করে সে। আর ওমনি শুরু হয় কালবৈশাখী। ব্যাস! শুধু এই না চাওয়া টুকু বাদ দিলেই স্যাঁতস্যাঁতে ছায়া ছায়া অন্ধকার উধাও। ভালোলাগা জড়িয়ে একে একে আসে রঙবাহার হোলি, উত্তেজনার চড়ক, পয়লা বৈশাখ, রবিপ্রণাম। আর ভালোলাগার মানুষ বা মানুষীর আড়চোখের চাউনি যদি মিশে যায় তার মাঝে! তাহলে পৃথিবী শান্ত হয় নিস্পাপ অনুরাগে।
অক্ষর বৃত্তও বাসন্তিক শুভকামনা জানাচ্ছে পরম অনুরাগে তার প্রিয় পাঠক ও স্রষ্টাদের। 


সুমিতা দাশগুপ্ত

পথ ভোলা 




প্রতিদিনের মতোই,আজও ডিনার সেরে, একটু হেঁটে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো রজত।

 অন্য দিনের তুলনায় ঠান্ডাটা কী আজ একটু  বেশি ? জ্যাকেটের চেনটা গলা অবধি টেনে দিতে দিতে ভাবছিলো সে। 


ওই দিকের বেডরুমে মা, ডিনার শেষে ওষুধ বিষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কাজের মেয়েটি যথাসময়ে, মায়ের বিছানা ঝেড়েঝুড়ে, লেপের নীচে হটব্যাগ দিয়ে আরামপ্রদ করে রাখে। বিহার ঘেঁষা এই অঞ্চলের ঠান্ডাটা মায়ের ঠিক সহ্য হয় না। রজত বলেছিল শীতকালটা কলকাতায় কাটিয়ে  আসতে, কিন্তু মায়ের বোধহয় ওখানে একা একা মন টিঁকছিলো না।

 কলকাতাবাসিনী,বন্ধুবান্ধব পরিবৃতা মা, আগে তাঁর তথাকথিত সমাজসেবা,পার্টি, পিকনিক,ছেড়ে অন্যত্র
থাকার কথা ভাবতেই পারতো না। আর এখন! সেই সব সঙ্গীসাথীর দল কোথায় যে উধাও হলো কে জানে।  বাবার  আচমকাই   চলে যাবার পর ধীরে ধীরে  সব ফাঁকা হতে থাকছিলো। কারণটা ঠিক বোঝা গেল না।  সে কী বাবার পদমর্যাদার গৌরব অন্তর্হিত হওয়া না কি অর্থকৌলীন্যে কিঞ্চিৎ টান! আসলে  প্রকৃত বন্ধু বলতে যা বোঝায়, মায়ের তা কোনদিনই ছিলো না। যা কিছু সবই বাবার দৌলতে। বাবার পদমর্যাদার, কৃত্রিম আলোতেই আলোকিত  থাকতো মা। ফলে মধুজালিকায় মধুর টান পড়তেই মধুমক্ষিকার দল উড়ে গিয়ে অন্য চাকে বসলো। 

 আরোপিত গ্ল্যামারের স্পটলাইটে ভাসতে গিয়ে,  কতো যে ক্ষতি করে ফেললো মা, কেবল  নিজের নয়, একমাত্র সন্তান  রজতেরও..,বুঝতেই পারলো না,হীরের বদলে স্রেফ কাচের টুকরোই আঁচলে বেঁধেছে। যখন বুঝলো তখন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। 

রজতের ভবিষ্যত জীবন নিয়ে আজকাল মায়ের 

 হা হুতাশের অন্ত নেই , কিন্তু সব ভুল কী আর শোধরানোর!

 এই  চল্লিশের কোঠায় পা দেওয়া  রজতও  আর এইসব নিয়ে ভাবতে চায় না। নতুন করে সমস্যা তৈরি  করে কী লাভ!  বরং  নিজের চাকরি বাকরি, বইপত্র, গান , একটু আধটু লেখালেখি এইসব নিয়ে, নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়ে মোটামুটিভাবে  ভালোই আছে সে। একটাই তো জীবন। একটু স্বস্তিতে কাটানোর অধিকার তো সকলেরই আছে। এছাড়া জীবনের চড়াই উতরাই পার হতে, মনখারাপের সঙ্গী হয়ে রবীন্দ্রনাথ তো রইলেনই আজীবন। 

 ভাগ্যিস সেই ছেলেবেলাতেই  বাবা  এই পথের হদিস দিয়ে গেছেন।

 রবীন্দ্রসংগীতটা সে খুব মন দিয়েই শিখেছিলো। ফলে শুধু রবীন্দ্রসংগীতের বাণীই তার উত্তরণের দিশারী। 


"এই ঠান্ডায় না বেরোলেই নয়?"‌ মায়ের গলা..


"এই তো  এখুনি ফিরে আসবো , সামান্য একটু না হাঁটলে ঘুমটা ঠিক হয় না!"    


স্বাস্থ্য রক্ষার্থে নিয়ম করে হাঁটাটা রজতের ডেইলি রুটিন , আর আজ তো অদ্ভুত এক  অস্থিরতা, ভর করেছে তার উপরে! 

 

বাংলোর বাগান, গেট, ওয়াচম্যানের সেলাম, পেরিয়ে, রাস্তায় পা রাখলো রজত।  

শীতের রাতে পথ এখন শুনশান।

গোল টুপি পরা সারিসারি পথবাতি, যেন নিজেদের পাদদেশটুকুই আলোকিত রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত। বৃত্তের বাইরে বাকিটুকু আলোছায়ার মায়া। 

অদূরে কুয়াশা পাক খায়। সামনে অষ্পষ্ট পথের ইঙ্গিত, অনেকটা  তার নিজের জীবনের মতোই। যখন‌ই মনে হয়, সামনেই আলোকোজ্জ্বল‌  সরণি,পরমুহূর্তেই, সবকিছু ঝাপসা,  এলোমেলো, দিশাহীন।

জ্যাকেটের পকেটে রাখা  হাতদুটো ঠান্ডায় কালিয়ে যাচ্ছে, রজত তবু  ঘোরের মধ্যে হেঁটেই চলেছিলো।

 মনটা আজ তার বড্ড উচাটন। বহুকাল বাদে সেই ভোলা দিনের সৌরভ, আজ আবার বারেবারে আনমনা করে ফেলছিল তাকে। 


সকাল বেলা অফিস যাবার আগে, সে তখন ব্রেকফাষ্ট টেবিলে, মা সামনের ঘরে টিভি রিমোটের বোতাম টিপছিলো, একটি চ্যানেলের আমন্ত্রণে নামজাদা শিল্পী গাইছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান.. 

কত যুগের ওপার থেকে, মনের নিভৃতে  লুকিয়ে থাকা গানটা,

 ঝাঁপিয়ে এসে পড়লো চেতনায় ,আমূল নাড়া দিলো রজতের সমগ্র সত্ত্বাকে...

  সেই কবে যেন একজন, মগ্ন হয়ে  গেয়েছিলো "মিলাবো নয়ন তব নয়নের সাথে... "

 

বাড়ি ফিরেই  মা রাগে ফেটে পড়েছিলো,

" ছিঃ, এই বেহায়া মেয়ের সঙ্গে কিছুতেই ছেলের বিয়ে দেবো না আমি,

গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। কোথাকার কোন স্কুলমাষ্টারের মেয়ের সাহসখানা দেখো, আমার হীরের টুকরো ছেলের দিকে হাত বাড়ানোর আস্পদ্দা তোদের হয় কী করে!  পাত্রকে দেখেই গান ধরলো চোখে চোখ মেলাবে, ছিঃ।"

বাবা অনেক বুঝিয়েছিলো ----

"ওটা রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গাওয়া, তোমার ছেলের উদ্দেশ্যে নয়।"

কিন্তু মা সেকথা মানলে তো।

মায়ের ধারণা সব মেয়েরাই ছেলেধরা। 

রজতের কিন্তু বেশ লেগেছিলো স্নিগ্ধ প্রকৃতির ভদ্র মেয়েটিকে,তার চাইতেও বেশি ছুঁয়ে গিয়েছিলো তার গান। নিখুঁত উচ্চারণ এবং সুরে রবীন্দ্রনাথের বাণী যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল জীবনদেবতার চরণ।উজ্জ্বল হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিলো সেইদিনের সকালটা। 

ওই মেয়েটিকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেলে আজ তার জীবনটা অন্য খাতে বইতো সন্দেহ নেই! 

 সেদিন মায়ের কথার বিরুদ্ধে যাবার মতো ব্যক্তিত্ব তার ছিলো না।ব্যক্তিত্ব না-কি ভালোবাসা! একমাত্র সন্তানই যে মায়ের চরম দুর্বলতা,সে কথা তো অনস্বীকার্য। জেনে বুঝে একটি অচেনা মেয়ের জন্য মায়ের  মনে আঘাত দিয়ে উঠতে পারেনি রজত। 

  

কবেই তো চুকে বুকে গেছে সবকিছু, তবু মনের বাসায় কেন যে, আজও তার  গোপন পদসঞ্চার কে জানে! মনের হদিশ  কে কবে পেয়েছে! 


মা  অবশ্য এইসবের ধার ধারেন নি কোন‌ওদিন।  অতি সাধারণ পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা মায়ের ধ্যানজ্ঞান‌ই ছিলো অর্থ আর প্রতিপত্তি। 

 রূপের জোরে, বাবার মতো উচ্চপদস্থ চাকুরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া মা, দিনে দিনে আর‌ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠছিলো। অবস্থায় এবং প্রতিপত্তিতে  সমতুল না হলে মা কাউকে কোনদিন পাত্তাই দেয় নি। 

  সেদিন‌ও তাই অন্য কারও মতামতের তোয়াক্কা না করে ওই মেয়েটিকে সরাসরি বাতিল করতে বাধে নি মায়ের।  হয়তো বা সেই খেসারতই, জীবনভর দিয়ে যেতে হলো রজতকে।

নিজের উপরে করুণাই হয় তার। 

সরকারি গাড়ি, প্রশস্ত বাংলো, উঠতে বসতে সেলাম। সেই রজতকে নিয়ে ভাগ্য কীভাবে হেলায়  ছিনিমিনি খেললো ! সব কিছু থেকেও আজ সে একেবারেই একা। 

 

 রজতের মতো সুপাত্রের জন্য মেলা সম্বন্ধ এসেছে বৈকি। বাংলাদেশে কি আর পাত্রীর অভাব ! ওই ঘটনার পর থেকেই মা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। আগে   যথেষ্ট খোঁজ খবর নিয়ে তবেই  অগ্রসর হতো। মায়ের দাঁড়িপাল্লায় যথেষ্ট ওজনদার না হলে মা আর এগোতোই  না। বাবা অনেক বোঝানোর চেষ্টা  করতো, কিন্তু কিছুতেই তর্কে এঁটে উঠতো না। এই প্রহসনে রজত আর নিজেকে  জড়ায় নি।

 ফলে সেই মল্লিকা নামের মেয়েটিকেই তার প্রথম এবং শেষ দেখতে যাওয়া।  তাই বোধহয় খুব সঙ্গোপনে আজও  মনের মধ্যে তার আনাগোনা। 


হ্যাঁ, বিয়ে,তারও একটা হয়েছিল বৈকি, মায়ের পছন্দসই পাত্রীর সঙ্গেই। 

  সে ছিল বিশাল বড়লোকের কোন‌ও এক  উড়নচন্ডী মেয়ে। সেধে সম্বন্ধ আসতেই মা আগুপিছু না ভেবে সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাবার ঘোরতর আপত্তিও মাকে টলাতে পারে নি।

আসলে ছেলের ব‌উ নয়, মায়ের দরকার ছিলো  উপরতলায় ওঠবার সিঁড়ি।

 যথাসময়ে নাম কা ওয়াস্তে  বিয়েটাও হয়েছিল , তবে টেঁকেনি।  একটাই সান্ত্বনা, মেয়েটি তাকে ঠকায় নি। ফুলশয্যার রাতেই সে, রজতকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলো, সে অন্য কাউকে ভালবাসে, এবং তার সন্তানের মা হতে চলেছে । একজন হিপির সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সহবাস। ছেলেটির ভিসা খতম, বলে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছে, তবে সে ফিরলেই ইত্যাদি ইত্যাদি...এবং সত্যি সত্যি কয়েকদিনের মধ্যেই সে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। 

এত সহজেই তাকে রেহাই দেবার জন্য রজত তার কাছে কৃতজ্ঞ। তারপর আর কোনো ফাঁদেই পা দেয় নি সে।  অনুরোধ উপরোধ ব্যর্থ হয়ে অবশেষে মা ক্ষান্তি দিয়েছে। 

লাভ হয়েছিল কেবল  মায়ের তথাকথিত সোসাইটির। মুচমুচে তেলে ভাজার মতো বিষয় কী আর রোজ মেলে! 

অফিসে  আজ সারাদিন প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে রজতের। ছোট বড়ো মিশিয়ে পরপর চার পাঁচটা মিটিং ছিল। লাঞ্চ খেতেও দেরী হয়ে গিয়েছিল তাই। 

সেকেন্ড হাফে সে নিজেই তার বস, নতুন জেলা শাসকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলো কিছুক্ষণ। কর্মসূত্রে বস হলেও, বয়সে রজতের কাছাকাছি, বেশ  সজ্জন ও আলাপী মানুষ বলেই মনে হয়েছে। 

আজ ফোন করার একটা বিশেষ কারণ ছিলো। তাদের এই ছোট শহরের প্রান্তে বিস্তীর্ণ এক শালবনের  মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গায়,  স্কাউট ও গাইডদের দিন তিনেকের ক্যাম্প চলছে। সারি সারি তাঁবুতে বাচ্চারা থাকছে, খেলাধুলার পাশাপাশি তাদের নানা ধরনের ট্রেনিংও দেওয়া চলছে। রজত একদিন সময় করে গিয়ে সবকিছু দেখেও এসেছে।  বাচ্চা বয়সে এই ধরনের ট্রেনিং বেশ কার্যকরী , বাচ্চারাও খুব এনজয় করে সন্দেহ নেই , সবচেয়ে বড়ো কথা ওরা সবাই সবার সঙ্গে মিশতে শেখে।আজকের এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে শিশুদের জন্য যেটা খুবই জরুরি। 

আগামী কালই শেষ দিন। ক্লোজিং সেরিমনিতে অনেকেই আমন্ত্রিত। সে তো বটেই জেলাশাসকও আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। সেই বিষয়ে কিছু কথাবার্তা সেরে নেওয়ার ছিল। 


রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক মাঝে মাঝে তীব্রতর হচ্ছে, ঘুমন্ত পাখির বাসা থেকে পাখির ডানা ঝাপটানোর  আওয়াজ। গাছের পাতা বেয়ে কুয়াশা নামছে ঝোপেঝাড়ে মাঠে ঘাটে ।  কতটা পথ চলে এসেছে রজত, খেয়ালই নেই।

 হঠাৎ সম্বিত ফিরলো  দূর থেকে ভেসে আসা মালগাড়ির হুইসিলে। কোথায় চলেছে কোন অজানায়, যাবার পথে বুঝি ডাক দিয়ে যায়! কিন্তু রজতের তো আর  যাবার নেই কোথাও,  তাকে তো ফিরতেই হবে! 


আচমকা সামনের কুয়াশার ভেতর থেকে গাড়ির জোরালো আলো পথে এসে পড়লো। 

কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল সেটি। পুলিশের গাড়ি। রজতকে দেখেই চিনেছে। 

" স্যার এতো রাতে এদিকে?"

রজত জবাব হাতড়াচ্ছিলো। 

বুঝেছি, ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছেন। চিন্তা করবেন না স্যার। এইমাত্র দেখে এলাম। সব ঠিকঠাক আছে। এতোগুলো বাচ্চা ছেলেপুলের সিকিউরিটির দায়িত্ব আমাদের উপরে। সোজা কথা! এতো বড়ো ক্যাম্প, এর আগে এই তল্লাটে কোনও দিন হয় নি। 

নতুন ডি,এম স্যারও আগামীকাল সমাপ্তি অনুষ্ঠানে  নাকি সস্ত্রীক উপস্থিত থাকবেন! আপনিও আসবেন তো ? "

মাথা হেলাল রজত। 

জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা, তার নতুন বস্ আসছে, তার না গেলে চলে!  হলেই বা ছুটির দিন। তাছাড়া ছোটো ছোটো বাচ্চাদের অনুষ্ঠান , মাকেও নিয়ে যাবে না হয়।ভালো লাগবে মায়ের, একা ঘরেই তো থাকে।

  

"ফিরলি?  আজ এতো দেরি করলি যে?"---মায়ের উদ্বিগ্ন গলা। 

" ঘুমোও নি? "

"তুই না ফিরলে... "

"ওই মানে একটু... স্যরি"

 খারাপ লাগছিল রজতের, ঈশ্ কী যে হয়েছে আজ,  নিজের কথা ভাবতে ভাবতে মায়ের কথা একেবারে ভুলেই বসেছিল! মায়েরই বা আর কে আছে সে ছাড়া! 

এতক্ষণ মাকে দোষারোপ করতে করতে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল বুঝি। 

তাছাড়া মাকেই বা একা কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে কেন।  নিজে তো আর কচি খোকাটি ছিল না।  উপযুক্ত চাকরি বাকরি করা পুরুষ মানুষ! অনায়াসেই মায়ের কথার প্রতিবাদ করে, নিজের সিদ্ধান্ত জানাতেই পারতো, না-কি তারও আর পাঁচটা দোকান ঘুরে দেখার মনোবৃত্তি কাজ করেছিলো! কে জানে, নিজেকে চেনাও কী অতো সহজ! 

আত্মবিশ্লেষণের ভাবনা ক্রমশ আত্মসমালোচনায় পর্যবসিত হতে হতে গভীর নিদ্রায় ডুবে গেল সে। 

পরদিন সকালটা বেশ রোদ ঝলমলে। ঠান্ডাটাও এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেছে। চটপট তৈরি হয়ে মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। ডি.এম আসার আগেই পৌঁছনো দরকার। 

মাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে অভ্যর্থনা কমিটির দলে এসে যোগ দিলো সে। 


যথাসময়ে ডি এম, সস্ত্রীক এসে পৌঁছে গেলেন, নমস্কার করে অধ্যাপিকা স্ত্রীর সঙ্গে, সকলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।

  প্রতিনমস্কার জানাতে গিয়ে, রজত স্থানুবৎ । মল্লিকা!! এ যে সেই মল্লিকা! কী চমৎকার ঋজু টানটান! সতেজ রজনীগন্ধার মতো তরতাজা অনুপম, আজো যার ভাবনা তাকে বিচলিত করে!! 


 নির্দিষ্ট কার্যক্রম শেষে সমাপ্তি অনুষ্ঠান।  কর্মকর্তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে ,ডি.এম সাহেব স্টেজে উঠলেন, তিনি নাকি একজন সুগায়কও। সঙ্গে ডেকে নিলেন

তাঁর গায়িকা স্ত্রীকেও।  সমবেত কন্ঠে, শিশুদের উদ্দেশ্যে, সহাস্য মুখে গান ধরলেন তাঁরা.... 

"আমরা এমনই এসে ভেসে যাই, আলোর মতন হাসির মতন, কুসুমগন্ধ রাশির মতন.... "

শালবনের মধ্যে দিয়ে সূর্যাস্তের রঙিন আলোর মাঝে সেই সুর, আনন্দের লহরী তুলে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সমস্ত শ্রোতাদের মন। 

পাংশু মুখে মা, জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন রজতের মুখের দিকে। 

মাথা নীচু করে রজত  বললো---     

"হ্যাঁ ।"

                     

 



সুস্মিতা কর

 


সেই বইমুখো বিদ্যাসাগরী





নারী শিক্ষা? ওসব থাক মশাই

ভোট পাওয়ার ভাষণেই বেশ মানানসই।

সহধর্মিণী, সহকর্মিণী? ওসব থাকুক বেদে

চড়ুইয়ের ন্যায় ক্ষুদ্র কাজ করে রেঁধে সেঁধে।

             পড়ার সাধ জাগছে কারও কারও

             দে পাঠিয়ে ইস্কুলে, ওই যে বালিকা বিদ্যালয়!

             পারবে না কি বইতে মোটা মোটা বইয়ের বহর?

             দেখবে, বসে আছে বইটাকে মুখের উপর উলটায়...

যত্ত সব গাঁজাখুরি স্বপ্ন,

বলে শিক্ষিত হবে? আটবে রোজগেরের তমকাটা?

তা চুল খুলে পড়াশোনা হয়?

ও সব ছেলে ধরার যাতাকল, নষ্টা মেয়ে একটা।

              বলি শুনুন মশাই, গৌরীদানটা সেরে ফেলুন

              জানেনই তো এটা সবচেয়ে বড় দান!

              পড়ার ইচ্ছা থাকলে? সে স্বামী পড়াবে

              তাহলে সম্বন্ধ করুন, ভোজ খাওয়ান.....


বাজে সানাইয়ের সুর পিতৃগৃহে..... চড়ুইয়ের মতো-

এর ওর ঘুলঘুলিতে বাসা বাধেঁ নারী,

আজও সেই বইমুখো জীবনের অপেক্ষাতে

বিদ্যাসাগরের স্বনির্ভর নারী।



সুশান্ত সেন

 দি




দিন গুলো ছোট করে কেটে 

রাত গুলো বাড়িয়ে দিলে

ভালো হতো মনে হয়,

তাহলে ঘুমাবার সময় একটু বেশি হতো

আর হত্যা গণহত্যা খুনোখুনি হানাহানি ইত্যাদি

সকল মনুষ্য বৃত্তি গুলি

কিছু টা লাগাম পরে আস্তাবলের ভেতর 

থেকে যেত কিছুক্ষণ।


ফোয়ারার জল খেয়ে

চিহি চিহি ডাক ছেড়ে সময় কাটাত 

বেশ কিছুটা কাল।


এই ভেবে যেই একটু কম্বল জড়িয়ে 

শুতে গেলাম, 

শুনতে পেলাম দরজায় কারা কড়া নাড়ছে।



দিলীপ পন্ডা

অভিমান



তোমাকে নিয়ে আমি একবার একটি গান লিখে

পাঠিয়েছিলাম।আজ আবার একটি গান

বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে বসে আছি

তোমার ধ্যানে  মিশে যাওয়ার জন্য।


জন্মদিন এলে

জন্মদিন চলে গেলে

তোমার সমগ্র সস্তায় নামিয়ে আনি

তুমি বসে থাকো চুপচাপ,ধ্যানস্হ।

তোমার জন্য কেউ আসন রাখেনি

তোমার জন্য কেউ মালা গাঁথেনি!

একমাত্র  আমিই দাবি করছি---

আমিই তোমার উত্তরসুরী।


যে ভারতবর্ষ  তুমি হাঁটতে হাঁটতে রক্ত ঝরিয়েছিলে

সে তোমাকে  ঝালমুড়ির মতো বিকেলের সুর্যাস্তে

বিক্রি করে বসে আছে।

আমি আজ একবার দেখলাম

তোমার সেই অভিমানী মুখ

জানলাম সন্ন্যাসীরও অভিমান হয়।


গোপাল বাইন

মৃত্যু




-চলে গেল! বাঁচানো গেল না!

দু-একজন পরিজনের মৃত্যুতে

হাহাকারে ভরে ওঠে পরিমন্ডল।


-দাদু মারা গেল।এই তো দু-দিন হলো!

কোনো কোনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে

বসন্তের বাতাস ঝিরঝির করে বয়।


কোথাও মৃত্যু বুকের আগুন, কোথাও মঙ্গলঘট

সুদীর্ঘ ইতিহাসকাল থেকে হতাশা এবং প্রশান্তি

পাশাপাশি বহন করে নিয়ে চলেছে।


গৌতম কুমার গুপ্ত

আমাকে দেখুন 



এই আমাকে দেখুন আধুনিক হতে গিয়ে আমি এখনও সেই পুরোণো হারকিউলেসে

যার প্যাডেল খুলে পড়ে গেছে চৌরাস্তায়

কোনরকমে ঠেলেঠুলে আমলৌকা এস এন  ব্যানার্জি পেরিয়ে তিলক রোডের আটের চব্বিশে

তার মধ্যেই বার চারেক খুলে গেছে চেন

ঢিলেঢালা ব্রেক নিয়ে পৌঁছে গেছি অবশেষে


প্রতিটি আটটা সাতটা টাইমপিসে নিত্যযাত্রীর তেলচিটে ব্যাগ নিয়ে

দাঁড়ভাঙা চিরুণি টুথব্রাশ দাঁতের মাজন

বাঁকুড়ার চার বাই তিন তোয়ালে গা্মছা ইত্যাদি

অনেকগুলো রোটারি পেরিয়ে সেই কোলফিল্ড কয়লাধূলোর রোড লেভেলক্রসিংয়ে আটকে থাকা হৃদপিন্ড নিয়ে ছুটে গেছি অফিস করণিকের দপ্তরে

স্টিল টাউনসিপ থেকে এক কুড়ি চার কিলোমিটার দূরে

ফুসফুসে আটকে গেছে কার্বন সিলিকোসিসের অণু পরমাণু


ক্রমে ক্রমে কেটে গেছে ষোলো ইনটু তিনশো পঁয়ষট্টির দিনের সালতামামি

কলিয়ারির চানক টবগাড়ি বেষ্টিত লোহার বেড়ি

চিমনির ভোঁ

এইসব পরিক্রমণ সেরে যখন থিতু হলাম বাণিজ্যিক শহরে

সাহিত্য সহবাসে কেটে যাচ্ছে সুশীল দিশারী হীরক নিখিল রাজীব কাকলির কাব্য অনুষঙ্গে

নয়নের আঠারো লাইনের রূপকল্পে

অমিত অরণ্যার কবিতার মায়াজালে

অলক্তিকার শব্দের মেটাফরে আত্মিক অনুভবে

আহা, এখানে জমে আছি বেশ বরফজমাটে শপিংমলে ফ্লুরোসেন্টের জাফরানি আলোয়


এখানে আমাকে সবুজ নয় বাদামি দ্যাখায় নাইলনের চেয়ারে

সে্ঁটে থাকি শ্রাবণে রিমঝিমে ও হেমন্তের অরণ্যে বসন্তের সোচ্চার পলাশ কিংশুকে

গ্রীষ্মের ভরদুপুরে ও ডিসেম্বরের শীতার্ত তোষক লেপে


জানিয়ে রাখি আমিও দু চার কলম লিখি

খুঁটে খাই অক্ষরের দানা

চর্ব্য চোষ্য অবশেষে বর্জ্য পড়ে থাকে কবিতা আবাসনে

যাপনের রঙেচঙে ফ্যাকাসে কিছু স্টিলজাত ছাই

আমাতে বর্তায়

ছাই মেখে বসে থাকি বহুরূপি হয়ে কবিমুখের  বহতা গরলে

আমি এখানে নদী খুঁজি স্রোত খুঁজি 

ইচ্ছা হয় বয়ে যাই স্রোতস্বিনী হয়ে

গালে হাত দিয়ে ভাবি সব্যসাচী মণিশংকর 

কে তিনি একই হাতে ভাস্কর কালু ডোম লোহার

পিনাকীর কবিতা কথকতা নিজামের নজরুল- কথা

কিভাবে ছুঁতে পারি ওইসব মেহগিনি টিকউডের দারুণ আসবাব

আমি যে আকর্ষহীন সামান্য গুল্মলতা

গোড়াতে সার ও জল চায় মাটির দোঁয়াশ

একা একা সেঁটে থাকি এঁটেলের দায়ে

জল ধরে রাখার পাশাপাশি উর্বরে নিমিত্ত ছোঁয়াচ

অন্তরীণে একাকি গুনগুনে গানের গুঞ্জনে মাথা দোলাই


মুক্তি সরকার

 লবণাক্ত ভালবাসা 




ভালবাসতেই যদি হয়

তবে ফুটপাতের ঐ অসহায় মেয়েটিকে ভালবাসো,

যাকে মাঝরাতের আঁধারে তুমি খুঁজেছিলে।

আর ঐ স্টেশনের শিশুটি,

ছেঁড়া ,নোংরা জামা পরে অ্যালুমিনিয়ামের থালা হাতে 

দুটো টাকা ভিক্ষা চাইছিল 

ওকে একটু ভালবাসো!

দুর্গাপুজোর ভিড়ে,ঈদের নামাজের পাশেই

ওরা ঘুরে বেড়ায়!

ভালবাসতেই যদি হয় 

তবে ঐ পরিচয়হীন শিশুটিকে, 

ডাস্টবিনে ফেলে গিয়েছিল 

কুকুরে একটি আঙুল ছিঁড়ে খেয়েছিল,

তবে প্রাণটা ছিল 

ওকে একটু ভালবাসো।

কোলাহলে না হোক,নিরিবিলি সময়ে।

এভাবেও প্রেম হয়।


সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...