শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

জয়িতা ভট্টাচার্য


অবয়ব


শিশির নিয়ে তেমন কোনো আদিখ্যেতা আজকাল নেই। ভরা নীল আকাশও পড়ে থাকে একা।কেউ দেখার নেই।সকলের চোখ নিবদ্ধ চলভাষে।জয়ন্তও একদিন এমনই ছিল।তারপর হঠাৎ সব পাল্টে গেলো।ওই

দুরে দেখা যাচ্ছে এখন সুবর্ণরেখা।মাঝে মাঝে হাতির পিঠের মতো উঠে আছে পাথরের চাঁই।ডিজিটাল ভারতে যতক্ষণ নেটওয়ার্ক আছে বাকি নিখিল জগত মিথ্যা।কিন্তু  জয়ন্ত এখানে একা।জঙ্গল পথে হাঁটছে।দু চারটে ছেলে ছেঁড়া জামা ঢিলে ইজের পরে খেলা করছে।খড়ি ওঠা গা।এই দারিদ্র্য পিড়িত এই বনাঞ্চল,এই নদী,এই পাহাড়ের ঝর্ণা...এরা সুখী।এরা কিছু আশা করে না। এইচ সি এল এর ফ্যাক্টরি সুপার হয়ে মাসকয়েক হলো জয়েন করেছে জয়ন্ত কলকাতা থেকে এসে।ক্রমে এই নগ্ন প্রকৃতি গিলে নিচ্ছে তাকে।আবছা হয়ে যাচ্ছে শহরের ছবি,পরিজন এমনকি মধুপর্ণা।এইসব অরণ্য, আদিবাসীদের গ্রাম আর হাড়িয়া বিরাট একটা আকাশ... জয়ন্ত হারিয়ে যাচ্ছে।এখানে সভ্যতা কম,অসভ্যতাও কম।একটা
টিলার ওপর উঠে বসে আছে জয়ন্ত।নীচে সবুজ উপত্যকা।এত নির্জন,মনে হয় এই গ্রহে একমাত্র মানুষ সে।সন্ধ্যা নামছে।পোকাদের আওয়াজ, পাখি আর বড় বড় শালপাতা হলুদ পাতারা ঝরে পড়ছে।এখানে বেশি রাতে জঙ্গলে এবং এসব জায়গায় ঘোরাঘুরি বারন শহর থেকে আসা লোকেদের।মাওবাদী অধ্যুষিত ছিল এসব এলাকা কিছুকাল আগেও।এখন একটু কম তাদের উপস্থিতি।আরণ্যক লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ এই অঞ্চলে বসে।তখন বোধহয় মাওবাদীদের আগমন হয়নি।সাবধানে নেমে আসে জয়ন্ত পিচ রাস্তায়।মন ফেরাতে এসে বসে ছোট্ট চা দোকানে।বাড়িটা হাতছানি দিচ্ছে।রোজ ডাকে।পাহাড়ের এপাশে রাস্তা পেরিয়ে জনবসতি থেকে দূরে।প্রথম দিনেই তার বাড়ির মালকিন বারন করে ছিলেন ইঙ্গিতে।মিস্টার নিহার টুডুর স্ত্রী।জয়ন্ত ভেবেছিল মাওবাদীদের কারনে।কিন্তু তারপর চা দোকানের সত্য আর ড্রাইভার বাপিরও একই সতর্কতা। বাড়িটার প্রসঙ্গ উঠলেই অস্বস্তিকর নীরবতা। বাপী বলে "একা একা ঘোরেন বিকেলে কোনো অসুবিধা নাই খুব সেফ প্লেস।কেবল মাঠ পেরিয়ে ওদিকটা যাবেন না।"

--"কেন"

"কী দরকার বাতাস লেগে যাবে"

জয়ন্ত বোঝে।এখানকার সরল গরিব মানুষ অশিক্ষিত,এখনও ভূত প্রেত নিয়ে বাঁচে।রাতে ঘরে এসে মধুপর্ণার সঙ্গে কথা হয়।

" দ্যাখো,মনে হয় সমাজবিরোধীদের আড্ডা।নানা কাজকর্ম হয়।ওই জন্য এসব রটিয়েছে"।জয়ন্ত একমত হয়।মধু ওকে মিস করছে।একটু আদর করে ভিডিও কলে।রাখার আগে মধু বলে"শোনো,কাজে গেছ,ওসব জায়গায় তুমি আবার যেও না,কী দরকার!"

--"হুম" 

রাস্তাটা সন্ধ্যার পরেই শুনশান। তার মানে এই নয় যে বসতিহীন।অনেক বড় বড় বাড়ি।ছিমছাম বড়লোক পাড়ার মতো।কিন্তু মানুষের কন্ঠ নেই।অদ্ভুত এক নির্জনতা।সিগারেট খেতে বেরোয় এইসময় জয়ন্ত।তাদের বাড়িটার আগে বিরাট একটা মাঠ অন্ধকারে পড়ে আছে।দু চারটে অল্প বয়সী ছেলে জোট বেঁধে নেশা করে।একটু এগোলে আলোকরেখার মতো পিচরাস্তা।দু চারটে দোকান।একটা দুটো লোক ইতস্তত ছড়িয়ে।

ভূত বাংলো নামে রটিয়েছে এখানে সবাই। অথচ,কী সুন্দর ছিমছাম একটা একলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।নিঃসঙ্গ প্রেমিকের মতো দয়িতার অপেক্ষায়।জয়ন্ত অন্ধকার পথে হাসে নীরবে।এইখানে এসে সাহিত্য জাগছে নাকি তার।

এইচ সি এলে র অফিস এপারে ওপারে  শোধনাগার। তিনটে গেট।সিকিউরিটি পেরিয়ে প্রথম বিল্ডিং তারপর খোলা উঠোনের ওপারে ইউরেনিয়াম ঘষামাজা হচ্ছে।জয়ন্ত ঘষামাজা বলে আসলে দীর্ঘ অনেকগুলো ফেজ মাটির নীচ থেকে তুলে সাজিয়ে গুজিয়ে বিশ্বের বাজারে পা দেওয়া অবধি।

আপাতত লিচিং এ রয়েছে সে। শোধিত ইউরেনিয়াম মূলত ইলেক্ট্রিসিটির কাজে ব্যবহার হয়,কিছুটা মেডিক্যাল আইসোটোপ তৈরী আর জাহাজের প্রপালশনে কাজে লাগে।সারাদিন কেটে যায় এসিড এলকালি ডোবা জলে ইরোনিয়াম চোবানো আর সংগ্রহের ঠিকাদারিতে। শ্রমিকরা আসে আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে।জঙ্গল পথে ছোটো ছোটো অসংখ্য গ্রাম।ফেরার পথে ওদের বাড়ি দেখা যায় নিকোনো ছিমছাম হাঁসের পাল মুর্গির ছানা,গরু বাছুর ছাগল।প্রায় রোজ একই গন্তব্য জয়ন্তর। ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে চলে যায় টিলার ওপর।ওখান থেকে সমস্ত চরাচর দৃষ্টিগোচর হয়।একপাশে ছোট্ট মন্দির ভোলেনাথের হলুদ পাথরের গায়ে লাভ সাইন, অনিতা রাজেশ।বাড়িটা অদ্ভুত আকর্ষণ করে। প্রতিদিনই। 

বাড়ির একমাত্র ওয়ারিস শোনা যায় অন্য কোনো রাজ্যে থাকে।বাড়ির মালিক ও তার পরিবারের সকলে কী এক অজানা রোগে মৃত বিকৃত পাওয়া যায় বহু বছর আগে। দুজন সদস্য আত্মঘাতী অথবা খুন হয়ে যাবার পরে বাড়িটি পরিত্যক্ত।রটে যায় ভূত বাংলোর গসিপ।

চা দোকানের মালিক গল্প করে প্রথম কেয়ারটেকারকে পেছনের জমিতে মৃত পাওয়ার পর এসেছিল আরো এক কেয়ারটেকার যার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।তারপর থেকে কেউ যায় না ওখানে বিকেলের পর।

গল্পটা মোটামুটি মিলে যায় বাপির বয়ানের সঙ্গে।জয়ন্তর ছোটোবেলার ভূতের গল্পের মতো মনে হয়।এন্টিসোশালের আড্ডা বোঝাই যায়।

গরম গরম আলুর চপ আর বেগুনি খেয়ে একটু বসে মাঠে।হাল্কা হিম।বাড়ির সঙ্গে কথা হয়।মধুপর্ণার সঙ্গে একটু কথা বলে অন্যমনস্ক হয়ে।দু একটা কালো ছায়া চকিতে সরে যায়।শেয়ালের মতো,কুকুর অন্ধকার মাঠে বৃত্তাকার ঘোরে।বাদুড় ওড়ে মাঠের আকাশে।

জয়ন্ত ফিরে কাজে বসে ল্যাপটপ খুলে।প্রায় রোজ 

সন্ধ্যার পথে একা জয়ন্ত শুকনো পাতা মারিয়ে নামতে থাকে টিলা থেকে,পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে।পেছন পেছন একইভাবে মনে হয় কেউ নামছে। কিন্তু  মরা বিকেলের আবছায়ায় কোনোদিনই কেউ থাকে না।কাজ থেকে ফিরে বিকেলে জয়ন্ত আসে যখন স্থানীয় অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা আসে প্রেম করতে টিলার ওপর।দু একজন বৃদ্ধ।অবশ্য সিজনে লোক আসে কলকাতা থেকে। কিন্তু বিকেল হতে না হতেই ভিড় গায়েব।সারি সারি গাছ রাস্তা আটকে রেখেছে,দু একটা ঘাসফুল।বাকি সব নিস্তব্ধ। আজ অন্যমনস্ক ভাবে মাঠ পেরিয়ে হাঁটে জয়ন্ত।সূর্যের শেষ আলো পড়েছে বাড়িটার গায়ে।হঠাৎ যেন সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে। লাল বাঁধানো সিঁড়ি কয়েকধাপ উঠে শূন্য দালান।ধুলো,শুকনো পাতার আস্তরণ। এই প্রথম পা রাখে বাড়িটায় জয়ন্ত।কেমন একটা গা ছমছম ভাব।গসিপের এফেক্ট।সমস্ত বাড়ির

দেয়াল বেয়ে উঠেছে বট অশত্থ।

একটা নিঃসীম শূন্যতা পাক খাচ্ছে।একটা ছোট্ট শিশু দৌড়ে চলে গেল পেছনদিকে।

জয়ন্তও বাড়িটার একদম পেছনে চলে এসেছে।বুনো ঘাস আগাছা আর পার্থেনিয়ামে র জঙ্গল।ছেলেটা টুক করে গায়েব নিমেষে।জয়ন্তর প্যান্টে চোর কাঁটা ভরে আছে।অনেক দূর অবধি কাঁটাঝোপ।জয়ন্ত পরীক্ষা করে বাড়িটার জানলা দরজা বাইরে থেকে ইঁট গেঁথে সিল করে দেওয়া হয়েছে।

ভেতরে কী আছে?কারা?

জয়ন্তর মনে পড়ে যায় প্রাচীন কালে জীবন্ত মানুষকে এভাবে গুম খুন...ধূর কী সব ভাবনা।জয়ন্ত নজর করে ঘুরে ঘুরে।সব যে বন্ধ তাও নয়।একেবারে পশ্চিম কোণে একটা ঘর,  জানলায় কাঠের ফ্রেম,ভেতরটা কূপ।ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুটো একটা কাঁচ ভাঙা সেখানে মাকড়সার গভীর জাল।ঝুল ধুলোর আস্তরণ ভেদ করে ভেতরে নিশুত রাত যেন আটকে আছে।হঠাৎ ই পেছনে তাকায়। জয়ন্তর বুকটা ধরাস করে ওঠে।একদম পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা বুড়ি।তোবড়ানো গালে হিজিবিজি রেখা,ন্যুব্জ,হালকা শনের মতো চুল বটের ঝুড়ির মতো এলোমেলো নেমে এসেছে।জয়ন্তর পা দুটো শুকনো পাতার মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে।নির্বাক তাকিয়ে আছে বুড়ি ফোকলা মুখ জুড়ে হাসি,চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।জয়ন্ত পাথর হয়ে যায়।সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে।একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে  বৃদ্ধ হাসিটা আরও চওড়া একটাও দাঁত নেই, চোখ দুটো আরও ধূসর একইভাবে চোখে চোখ রেখে...এভাবে কত মিনিট মুহুর্ত সময় কেটে যায় ...

হঠাৎই জোরে হাওয়া দেয়, গা সিরসির করে জয়ন্তর।চমকে সম্বিত ফেরে।কিন্তু কৈ,কেউ তো নেই!কোথাও নেই মানুষটা।

হঠাৎ  হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বুড়িটা।জোরে একটা পোকা ডেকে উঠল।একটা কালো পাখি মাথার কাছ দিয়ে উড়ে গেল।জয়ন্ত ছুটছে।একেবারে পিচ রাস্তার আলোয় এসে হাঁফায়।চা দোকানের বেঞ্চিতে বসে বোবা মুখে জল খায়।মাথাটা ফাঁকা।

রাতে বসে আজ কোনো কাজ হয় না।একের পর এক চুমুকে শেষ হয়ে যায় কলকাতা থেকে আনা রামের বোতলটা।কী হয়েছে বুঝতে পারছে না জয়ন্ত। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডাকাবুকো জয়ন্ত অনন্ত চিন্তার জালে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।অসহায় পাতাকুড়ানি বুড়ি,নাকি হ্যালুশিনেশন নাকি,নাকি ছায়া।অবচেতন মন!নাকি ভেতরে জমেছে ক্লান্তি,একাকীত্ব।পরদিন অফিস যাওয়া হয় না।মাথা ছিঁড়ে পড়ছে।ওই বুড়িটা কে?মানুষ?জয়ন্ত ভয় পাচ্ছে কয়েক মিনিটের ওই শিউরে ওঠা একটা অনুভব যা তার ভেতরেই কি ছিল? যা বেরিয়ে আসতে চাইছে।মৃত্যু-বোধ!অসহ্য একটা কান্না পাকিয়ে উঠছে বুক থেকে।কঙ্কাল সার ফোকলা মুখ ওই বৃদ্ধা।হাসি।কে ও?মৃত্যু?তার,মায়ের র,বাবার, ভাই,মধুপমধুপর্ণার... সকলের।

মৃত্যু স্থির হয়ে দেখছে।এড়ানোর উপায় নেই। জীবন,প্রেম জন্ম সুখ আনন্দর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুর অবয়ব।ওই শনের নুড়ি বুড়ি নাকি মৃত্যুর রূপ।

জয়ন্ত বারান্দায় আসে,তীব্র রোদ্দুরে খেলা করছে দুটো ছাগল ছানা।একদল হাঁসের ছানা যাচ্ছে মায়ের পেছন পেছন।চোখ থেকে গড়িয়ে নামা জল মুছে নেয় জয়ন্ত।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...