শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

শান্তময় গোস্বামী




গুরুংবুড়ো ও হীরার হোটেল 


 


তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ অতি কম দিনের। দু-চার দিনের বেশি নয় মোটেই। তারপর, দশ বছর কোনো খোঁজখবর নেই। এই দশ বছরে কতো কিছু বদলেছে। সবচেয়ে বড় বদল যদি কিছু হয়ে থাকে, তা আমার মনের গঠনে। হয়তো তাঁরও মন বুড়িয়েছে, কি জানি তবু তিনি আমার কাছে একেবারে সেইরকমই রয়ে গেছেন, ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম।


 


তাঁর সঙ্গে আলাপ রামধুরায়। কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে তাঁর হোম-স্টেতে উঠেছিলাম। হোম-স্টের নাম তার পদবীর জোরেই… গুরুং হাউস। একেবারে পাহাড়ের ঢালের ওপরেই নিরিবিলি, ছোট পাহাড়ি গেস্ট হাউস। হোম-স্টের ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েক হাত চওড়া সিমেন্টের চাতাল পেরোলেই ডাইনিং এরিয়া। টালির আটচালা মতন, তলায় দু-তিনটে প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার। ডাইনিং এরিয়া শেষ হাতই ছোট্ট একটা বাগান। বাগানের সাদা রং করা কাঠের বেড়ার ওপারে রয়েছে আকর্ষণীয় নানান পাহাড়ি গাছ-গাছালির যত্নের সমাহার। বেড়ার গায়ে অনেকদিনের নানা রঙের অর্কিড।  


 


তাঁর চেহারা মোটাসোটা, তামাটে গায়ের রং। হাফপ্যান্টের ওপর, মস্ত বড় ভুঁড়ির মাঝখানে নাভিটা অদ্ভুতভাবে গোল হয়ে উঁচু হয়ে আছে। নাকের নিচে মোটা গোঁফ, হাসলেই ফোকলা দাঁত বেরিয়ে পড়ে। গুরুংবুড়ো ভোজনরসিক, নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ান। ট্রাউট মাছ, চিকেন, মাটন। রান্নার মশলা জানতে চাইলে হেসে শুধু বলেন… ‘কুছ নহি বস… আচ্ছা মন আউর বড়িয়া পাহাড় কা মসালা দেতা হ্যায়।’  


 


তখন আমার মেয়ে, রাই বেশ ছোট, তাই ব্রিজটার দু'পাশের লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে তার গা শিরশির করতো। নিচে তাকালে দেখা যেত, এক পাশের বিশাল ড্যামের জল অনেকটা ওপর থেকে হুড়হুড় করে পড়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে অন্য পাশটায় বয়ে যাচ্ছে। সে সময় লোহার শিকের রেলিংটা রাইয়ের মাথার চেয়ে উঁচু। ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে অনেকগুলো পুরোনো গাছ। একটা পাইন গাছের তলায় সিমেন্টের ছোট ভাঙা বেদি, তাতে সারাবছর একটা-দুটো ঠাকুরের মূর্তি রাখা থাকতো। হাতভাঙা হনুমান, নাকভাঙা দুর্গা… হোম-স্টে থেকে যাওয়া আসার পথে একঝলক দেখতে পেতাম। কেমন একটা হতাশ লাগতো। হয়তো রাইয়ের একটু ভয় ভয়ও করতো, কে জানে। ওর ছোট্ট নরম দুটো হাত আমায় আঁকড়ে ধরতো শক্ত করে।


 


গুরুং হাউসের সামনে একটা ছোট টবে একধরনের লতানে গাছ দেখে খুব পছন্দ হলো। গুরুং বুড়োকে বললাম। তিনি একটা মাটি দেওয়া প্লাস্টিকের ঠোঙায় একটুখানি লতা কেটে দিয়ে দিলেন, বললেন বাড়ি ফিরে জলের গামলায় রেখে দিতে। দিয়েছিলামও তাই কিন্তু কয়েকদিন যেতেই লতার পাতা হলুদ হয়ে যেতে লাগলো। বুদ্ধি খাটিয়ে জলে ওইখান থেকেই নিয়ে আসা কিছু পাথর দিয়ে রাখলাম। পাহাড়ি লতা, যদি পাথরের গন্ধে পাহাড়কে মনে করতে… চিনতে পারে। লাভ হয়নি। ফেরার দিন, গুরুংবুড়ো তার ছ্যাকড়া ওমনি গাড়ি নিয়ে আমাদের বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছতে এলেন। সঙ্গে তাঁর খাস বাদামী ল্যাব্রাডর, সে দেখি তাড়াহুড়ো করেই লেজ নাড়তে নাড়তে এসেছে। তারপর হুশ করে দশটা বছর কেটে গেল।


 


কয়েকদিন আগে হঠাৎ গুরুংবুড়োর কথা মনে পড়ল। গুগল করে দেখি, গুরুং হাউস এখনো আছে। হোম-স্টেতে থেকেছেন এমন অনেক মানুষ সদয় রিভিউ লিখেছেন। যোগাযোগ করাতে উত্তর দিলেন একজন অপরিচিত মানুষ। হোটেলের ম্যানেজার ঋষভ গুরুং। আমরা বুকিং করে পরের সপ্তাহেই এক সুন্দর সপ্তাহের শুরুতে পৌঁছে গেলাম গুরুংবুড়োর ডেরায়। কিন্তু ম্যানেজার গেছেন নিচে… শিলিগুড়ি। সপ্তাহের রেশন আনতে। খোঁজ খবর করাতে কিছুতেই গুরুংবুড়োর কথা জানতে পারছিলাম না। কিচেনটা আছে কিন্তু ওখানে অতিথিদের জন্য রান্না হয় না। একটু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই হীরার হোটেল। ওখানে গিয়ে বা অর্ডার করে দিলেই মিলবে খাবারের আতিশয্য।


 


বার বার বাইরে খেতে যাওয়াটা একটা অসুবিধে। উত্তরে হোটেলের ম্যানেজার ঋষভ গুরুং বললেন… ‘চেষ্টা করছি হোম-স্টের কিচেনটা আবার শুরু করার। তবে সেটা যেমনই হোক, নতুন রাঁধুনি এসে তো আর বাবার জায়গা নিতে পারবে না।’


 


পাইন গাছটাকে পেছনে ফেলে আরেকটু এগোলে, রাস্তার বাঁ দিকেই হীরার ভাত-মোমো আর কফি-চায়ের হোটেল। বাঁশের চাটাইয়ের চার দেওয়াল, বাঁশের ওপর প্লাস্টিকের ত্রিপলের ছাদ। দুপুরে রূপোলি কাগজের প্লেটে ভাত, ডাল আর একটা চালু সবজি। টমেটোর লাল ঝাল চাটনি সহ গরম মোমো, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা ময়লা ঝোলা থেকে বের করে টুকরো করে রাখা লেবু লঙ্কা পেঁয়াজ। এছাড়া আলাদা করে চাইলে স্টিলের ছোট ছোট চ্যাপ্টা বাটিতে ঝাল ঝাল স্কোয়াশের কষা ডিমের কারি, চিকেন। শুকনো শুয়োরের ঝাল মাংসের চাট, কোনো কোনো দিন তাও পাওয়া যায়।


 


রাতে রুটি হয়। একজন গেঞ্জি পরে, কোমর অবধি গামছা জড়িয়ে সারা সন্ধ্যে রুটি বেলে। উনুনের আঁচে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হীরা ডিম-তড়কা করে সেটার আড়ালে একটু ঝাল চিকেনের বাসি ঝোল মেরে দেয়। লোকে কাঠের বেঞ্চে বসে বাঁ হাত দিয়ে নাকের জল মুছতে মুছতে খায়। হীরার বয়স হয়েছে। বুক অবধি সোয়েটার তুলে ফোকলা দাঁত বের করে হাসে। টাকার হিসেবের অঙ্ক করতে গিয়ে অনেক দেরি লাগায়। কাস্টমার উসখুস করে। শীতের দুপুরে, এই জঙ্গুলে রাস্তায় কেউ নেই, ড্যামের জল শুকিয়ে ফুটিফাটা পাথর-মাটি বেরিয়ে পড়ে… তবু হীরার দোকানে আলগা ভিড় কমে না। বেশিরভাগই স্থানীয় ছাংয়ের অমৃতরসে তূরীয়। হীরা হাসে, বলে… ‘দেখিয়ে স্যর, সব ও গুরুং সাবকা কেরামৎ। স্যর কা কিচেনমে কাম শিখা ম্যায়নে।’


 


হীরার হোটেল ভীষণ চালু কিন্তু মাঝে মাঝেই সে হোটেল অনেকদিন বন্ধ রাখত। লোকে খেতে এসে ফিরে যায়, রাগ করে। হীরা ফিরে এলে জানতে পারে সবাই, সে কোনো নেপালী গ্রামে হনুমান পুজোয় ঢোল বাজাতে ও ভজন গাইতে গেছিল। এটাই ছিল তার নানান নেশার মধ্যে একটা।


 


ঋষভ গুরুংয়ের সঙ্গে ফিরে এসেও যোগাযোগ রেখেছিলাম। কেন রেখেছিলাম আমি নিজেও জানি না আর ঋষভও কেন আমার যোগাযোগে আগ্রহ দেখাত বুঝে উঠতে পারি নি। হীরার কথা শুনতে চাইতাম। আর ঋষভও ভালবাসার গুনে অথবা তার হোম-স্টের খাতিরেই আমায় হীরার সব কথাই বলতো। হঠাৎ একদিন বললো… ‘এই বার বর্ষায় প্রচণ্ড ঝড়-বাদল! অনেকদিন ধরেই বন্ধ হীরার হোটেল। লোকে রেগেমেগে শেষে যাওয়াই বন্ধ করে দিলো। বৃষ্টি মাথায় করে শুধুশুধু অতদূর ধুর ধুর… একদিন ভীষণ বৃষ্টিভরা সকালে জানা গেলো… নিজের বন্ধ দোকানের ভিতরেই মরে গেছে গুরুং বুড়োর প্রিয় রাঁধুনি আর হনুমান ভক্ত গাইয়ে-বাজিয়ে… হীরা।’ 


 


পরদিন নাকি বৃষ্টির তোড়ে ড্যামের জল ফেঁপে উঠে ব্রিজ ভেঙে দিয়ে ওপাশ দিয়ে বয়ে গেছিলো ।।


 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...