এক মেয়ে শিব্রামের গল্প
কেলেঙ্কারির শুরু। যথাসময়ে হাজির হলাম ছাত্রীর পড়ার ঘরে।
“কি নাম তোমার? ডাকনামটা তো জানি, ভালো নামটা বলো”
“কেন ডাকনামটা কি খারাপ নাকি আমার, আঙ্কল?”, ছলছল চোখে বলে মেয়ে, “রিমি নামটা কি খারাপ?”
“আরে নানা তা বলিনি,” সাততাড়াতাড়ি বলি আমি, “রিমি বেশ ভালোই নাম তো,তুমি স্কুলের নামটা বলো”
“সেইন্ট অগাস্টিন কলেজিয়েট স্কুল, হাওড়া, এস্টাব্লিশড ইন...”
“আরে না না এটা জিজ্ঞেস করিনি তো আমি,” ব্যস্ত হয়ে থামাতে হয় ওকে ।
“কেন আঙ্কল তুমিই তো স্কুলের নামটা জানতে চাইলে”, রিমি বিরক্ত মুখে ব্যক্ত করে এবার।
“আমি তোমার স্কুলের নাম জানতে চাইনি, স্কুলে তোমায় যে নামে ডাকা হয় সেটাই জানতে চাইছি শুধু।”
“কোন নামটা বলি বলো তো? সুদিপা ম্যাম বলেন সিলি গার্ল, বাস্কেটবল টিমের মেয়েরা বলে ক্যাপ্টেন, উঁচু ক্লাসের মেয়েরা বলে পুচকি আর স্কুলবাসের দাদুটা বলে পাকাবুড়ি...”
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে এসির রিমোটটা তুলে নিয়ে বাটন টিপে দেয় সে। কি করে বুঝল যে একটু ঠাণ্ডা বাতাসের দরকার এখন আমার, কে জানে। বেশ অভিজ্ঞ খেলোয়াড় বলতে হবে। কিন্তু আমিও দমবার পাত্র নই। দম বার হয়ে গেলেও দমি না সহজে।
“স্কুলের রোল-কলের খাতায় তোমার যে নাম লেখা আছে, সেইটা বলো।”
“রোল-কলের খাতায় কি লেখা আছে দেখিনি তো। আমাদের তো রোল নাম্বার বলে বলে এটেন্ডেন্স দেয়া হয়। আমার নাম্বার থার্টি ওয়ান।”
“আচ্ছা বেশ, স্কুলের রেজাল্ট বইতে তোমার কি নাম লেখা আছে সেটা তো বলতেই পারবে নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ সে পারব না কেন, শুধু রেজাল্ট বুক কেন, সব বুকেই তো লেখা আছে, ওই তোমার হাতে যেটা সেটাতেও, এটা আবার জিজ্ঞেস করবার কি আছে।”
“বেশ সেটা না হয় একটু নিজের মুখেই বলো শুনি।”
“ও আমার মুখে শুনবে, আগে বললেই হতো সেটা, মাই অফিসিয়াল নেম ইজ বিষ বাজিতা বোস।”
বসেই তো ছিলাম।তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে হল এবার। বিশ্বজিতার এহেন উচ্চারণ হতে পারে তা একেবারেই আন্দাজ করতে পারিনি আগে।একবারে ইয়ার্কি মেশানো ইয়র্কার। গুলি ভরা গুগলিও বলা যেতে পারে।
“ওটা বিশ্বজিতা হবে বাবু, বিষ বাজিতা নয়।বিষ বাজানোর জিনিস নয়, বাজিয়ে দেখতে গিয়ে মরেছে কত লোকে।”
“রিয়েলি? কিন্তু সবাই তো ঐ ভাবেই ডাকে আমায়। বিশ্ব না কি যেন বললে, তা তো কেউ বলেনি এতদিন।”
- “মা রে, সেটা তোর দোষ নয়, দোষ তোর বাবা মায়ের।স্কুলের শিক্ষকদের। উচ্চারণ বদলে গেলে যে নামের অনর্থ ঘটে যায় সে বোধ এদের নেই…”। এসি থেকে বেশ একটু দম নিয়ে নিই বুক ভরে। বাংলায় একে বাতানুকূল যন্ত্র না বলে দমকল কেন যে বলা হয় না কে জানে।
- “তোমার নাম বিশ্বজিতা বসু, মনে থাকবে তো? দাও দেখি খাতাটা, বানানটা লিখে দিই আমি।এটাকেই একশ বার লিখে আমায় দেখাবে পরদিন। আজ ছুটি।”
ছুটে ছুটেই বাড়ি ফিরলাম একরকম। এক ড্রেসিং রুম থেকে আরেক ড্রেসিং রুমে। পালক ছাড়ানো মোরগা হয়েই এড্রেসে এসে দম ছাড়লাম খানিক। রাতে দাদার ফোন এলো। বোধহয় এটার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
“কি রে কেমন বুঝলি? পারবি তো?”
“দাদা, তোমার কন্যা তো বন্যা একেবারে। বন্যও বলা যেতে পারে। কথার জালে এমন ফাঁসাতে পারে এতটুকু মেয়ে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় একেবারে।”
“জানি তো। সেই জন্যেই তো তোর পাল্লায় চাপিয়েছি। মাস্টার যেমন, ছাত্রীও তেমন। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি এক্কেরে।”
“দাদা আমি বোধহয় পারব না...”
“পারবি পারবি তুইই পারবি। লোহার কাজে লোহার লাগে। আর তুই হলি যাকে বলে এক্কেরে, খেলোহার।”
“কিন্তু দাদা...”
“নো কিন্তু পরন্তু উপরন্তু। শুধু পারন্তু। শোন, মেয়ে আমার খারাপ নয়। ফার্স্ট হয় সব বিষয়েই।শুধু এই বাংলাটাতেই...। তোর মত শিক্ষক পেলে ওর বাংলা জয় হবেই হবে। কাল আসবি কিন্তু... স্পেশাল রাজভোগ আনিয়েছি সেন মহাশয় থেকে...”
লাইনটা কেটে যায়। রাজভোগের টোপ গিলিয়ে দুর্ভোগের রাজত্বে কালও গিয়ে হাজিরা দিতে হবে বেশ বুঝতে পারলাম। পড়েছ পুলিশের হাতে, রাজভোগ গিলে মর অপঘাতে।
দ্বিতীয় দিন।পড়ার টেবিলে রিমি। বিপরীতে আমি।এসি চলছে। বন বন করে পাখা ঘুরছে। টেবিলের উপরে প্লেট থেকে চারটে প্রমাণসাইজের রাজভোগ থানার বড়বাবুর মত চোখ পাকিয়ে আমাদের দেখছে।
“রিমি, তোমার নামটা লিখতে বলেছিলাম, লিখেছ?”
“ইয়েস আঙ্কল...”
খাতাটা এগিয়ে দেয়। মুক্তোর মত হস্তাক্ষরে পরিষ্কার করে লিখেছে:
আমার নাম বিশ্বজিতা বসু।
“বাহ, এই তো, খুব ভালো হয়েছে, এবার তোমার বাবার নামটা লিখে দেখাও তো একবার। আগে বলে নাও একবার শুনি।”
“এ আর এমনকি। আমার বাবার নাম প্রণবেশ বোস সরি বসুন।”
সবে একটা রাজভোগ হাতে তুলেছিলাম মাত্র। টুপ করে সেটা আপনা থেকেই নিজের যায়গায় ফিরে গেল। মুখে পুরিনি কি ভাগ্যি। নইলে হয়ত এতক্ষণে বিষম টিষম খেয়ে...
গম্ভীর গলাতেই বললাম এবার?“ "বসুন! বসুন আবার কারোর পদবী হয় নাকি? বসুন পেলে কোথায়?”
“ বা রে, বাপি বড় না আমার থেকে... বড়দের কি তুই তুই করে বলা যায়? আপনি আপনি করে বলতে হয় তো, মা শিখিয়েছেন। বোস বলি কিকরে? তাই....”
“আরে সেটা তো ক্রিয়াপদ মানে ভার্ব এর সময়,” কাতর গলায় আতর মাখিয়ে বলি আমি। রাজভোগগুলো হুমহাম করে হাসছে এবার আমার দিকে তাকিয়ে।
“বসুন মানে হল বসে পড়ুন আর...”
“ও আচ্ছা তার মানে বই টই পড়তে বললে তবেই বসুন বলে? নইলে বোস?”, রিমি অবাক হয় যেন এবার, “তবে মা যে বলে রোজ, রিমি পড়তে বোস...”
“আরে বাবা বসে পড়ুন মানে প্লিজ বি সিটেড...পড়াশুনা না করলেও চলে।”
“বাব্বা,” রিমি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে এবার, “কি কঠিন ভাষা গো তোমাদের, বোস, বসু, বসুন।এর থেকে ইংলিশ অনেক সোজা। বিজি লোকের ইজি ভাষা বলতে পারো।”
“এটাই তো এ ভাষার মজা রে মামণি। শুধু সিট বললে কি বোঝা যায় কাকে বলছিস, কি মুডে বলছিস? বাংলায় কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়। বন্ধু, না গুরুজন কার সাথে কথা হচ্ছে।”
- তা অবশ্য ঠিক, ইংলিশে সব কেমন যেন এক রকম শোনায়।ছোট বড়র ডিফারেন্স নেই।
তবেই বোঝ, একটা রাজভোগ ফের হাতে তুলে নিই আমি,তাহলে তোমার বাবার নামটা তাহলে বলো
“আমার বাবার নাম হল শ্রী প্রণবেশ বসু। মিস্টারের বাংলা শ্রী তো? ঠিক বলিনি?”
“একদম ঠিক,” রাজভোগটা কপাৎ করে মুখে চালান করে বলি, “বল এবার স্কুলে নতুন কি শেখাল....”
রাত্রে দাদার ফোন এলো আবার।
“কি রে তুই নাকি পড়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি আজ..”
“কিছু না দাদা, তোমার রাজভোগ খেতে গিয়ে বিষম লেগে গিয়েছিল আর কি...”
“শুধু রাজভোগ নাকি রাণীর প্রসাদও ছিল? রিমি আবার কিছু...”
“না না রিমি খুবই ভালো মেয়ে দাদা আমাদের। নিজের নাম, আপনার নাম খুব সুন্দর লিখে দেখাল বাংলায়, শুধু....”
“শুধু?”
“ওই বিপরীতার্থক শব্দ লিখতে গিয়েই হীতে বিপরীত হয়ে গেল...”
“সে কি রে... কি লিখতে কি লিখল আবার?”
“মোট পাঁচটা লিখতে দিয়েছিলাম, তিনটে ঠিকঠাক লিখেছে কিন্তু বাকি দুটো...”
“কোন দুটো?”
“ভেজা আর রোগা। ভেজার বিপরীত লিখেছে খোলা আর...”
“মাই গুডনেস... ভেজার বিপরীত খোলা হয় কিভাবে?”
“ওর মা নাকি কাজের বঊটাকে বলছিল, কিচেনের দরজাটা ভেজানো থাক বুল্টির মা... খোলা রাখলে বিড়াল ঢুকে পড়তে পারে। সেই থেকেই ধারনা হয়েছে ওর যে খোলার বিপরীত ভেজা।”
“তাও ভালো, অবজারবেশন পাওয়ার আছে মেয়ের বেশ। তা আর একটা ভুল কি করেছে বলছিলি যেন...”
“শুনবে?... একটু থেমে বলি আমি,মানে শুনতেই হবে? না শুনলেই নয়?....”
“কেন, কি এমন কথা যা বলতে গিয়ে থমকাচ্ছিস?”
“শুনলে কষ্ট পাবে কিন্তু”
“তবু শুনব, বল”
“দিন দুয়েক আগে নাকি তোমার সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, দারোগা সাহেব বাড়ি আছেন নাকি? আজ তোমার মেয়ে রোগা শব্দের বিপরীত লিখেছে দারোগা।কারন তার বাবা তো বেশ একটু...”
“থাক থাক, আর বলতে হবে না, জ্বালিয়ে খেল এই মেয়ে একেবারে।এই জন্যেই মাস্টার টেকে না একটাও...”
খুট করে লাইন কেটে গেল...
তৃতীয় দিন। সম্ভবত আজই শেষদিন। আজ রাতেই দাদাকে জানাতে হবে আদৌ এ গুরু-দায়িত্ব আমি নিতে পারব কিনা। দাদাও সম্ভবত আর চাপ দেবেন না। ঝটকাটা কাল আমার থেকে তিনিই বেশী পেয়েছেন কিনা। একটু আগে আগেই এসেছি আজ। আজ আর রাজভোগের আয়োজন নেই। দুর্ভোগের আশংকাতেই হয়ত এই আগাম রাজদণ্ড। মেয়ে অবশ্য নাচের ক্লাস থেকে ফিরে বেশ বাধ্য ছাত্রীর মতই পড়া করছে আজ। বিপরীত শব্দ সবকটাই ঠিকঠাক লিখেছে। দুই একটা বানান ভুল বাদ দিলে বাক্যরচনাতেও ভুল নেই কোনও। এখন একমনে আমাদের ছোট নদী কবিতাটা মুখস্থ করবার চেষ্টা করছে।
“আচ্ছা রিমি, কাল যে আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করলাম, কই তুমি তো আমার নাম জিজ্ঞেস করলে না।”
“মাথা খারাপ আর আমি নাম জিজ্ঞেস করব না কারোর কখনও।”
“সে কি, কেন?”
“এই নামের চক্করেই তো তিন তিনটে টিচার চলে গেল।”
“তাই নাকি, কিভাবে?”
“প্রথমে যে ম্যামটা এলো, তিনি তো খুব ভালোই ছিলেন। সুন্দরী, ইয়াং। তিন দিন ক্লাস করেওছিলাম বেশ। কিন্তু...”
“কিন্তু?”
“নাম জিজ্ঞেস করেই তো ফেঁসে গেলাম। যতবার জিজ্ঞেস করি,বলেন শু পর না, শু পর না...ঘরের মধ্যে কেউ শু পরে থাকে নাকি আবার? পায়ে একটা স্লিপার পরা ছিল বটে, সেটা খুলে শু পরে এসেও বসলাম। তার একটু পরে ফের নাম জিজ্ঞেস করতেই ম্যাম বেশ রেগে গিয়ে বলল, শু পর না বললাম তো, কতবার বললাম বলতো...”
“সুপর্ণা ছিল বোধহয় তার নাম,” এবারে বলি আমি।
“ মে বি। আমি তো ভাবলাম ওনার চোখে কোনও সমস্যা আছে। দিব্যি শু পরা দেখেও শু পরতে বলছিলেন খালি। শেষে একরকম ডেসপারেট হয়েই টেবিলের উপরে পা তুলে বললাম, এই দেখুন না শু পরেছি ম্যাম।এত সুন্দর লাল জুতো দেখতে পাচ্ছেন না আপনি? ওমনি ম্যাম রাগ করে সেই যে গেলেন আর এলেন না।”
“আর দ্বিতীয়জন? তারও কি নাম নিয়েই সমস্যা?”
-“হ্যাঁ তিনিও নামেই নেমেছেন। মানে আমার চোখে নেমে গেছিলেন অনেক।”
“কি রকম?”
“এই ম্যাম বেশ মোটাসোটা ছিলেন। খচরমচর করে সারাক্ষণ কিছু না কিছু খেয়েই যেতেন। একদিন মায়ের বানানো চিজ স্যান্ডুইচ আর চকো চিপস বেশ চালাচ্ছিলেন এই টেবিলে বসেই। এমন সময় আমি নাম জিজ্ঞেস করতেই উনি এক টুকরো স্যান্ডুইচ তুলে নিয়ে বললেন, নে, হা কর। আমি ভাবলাম উনি ভালোবেসে খাওয়াতে চাইছেন। তাই আমিও হা করলাম। ওমা, উনি অমনি টুক করে টুকরোটা নিজের মুখে ভরে আমাকে ধমকে বললেন, অমন হা করে তাকিয়ে আছ কেন মুখের দিকে? গুরুজনের খাবারের দিকে নজর খালি। হ্যাংলা কোথাকার। ভাবুনতো, আমাকে বলে কিনা হ্যাংলা। কত কত খাবার নিয়ে মা রোজ ফেড আপ হয়ে যান আমাকে খাওয়াতে গিয়ে। আমিও তাই রেগে গিয়ে বলে দিলাম তাঁকে, আমি হ্যাংলা হলে আপনি একটা হ্যাঙ্গার।“
“জল্লাদ বলে দিলি একদম... হ্যাঙ্গার!”
“হাঙ্গার বলাও যেত... যখনই দেখি মুখ চলছে খচরমচর। ফাটিচার একদম,টিচার মোটেও নন।”
“নেহা কর নাম ছিল বোধ হয় বেচারির। নামটাই তো হা করে আছে যেন তামাম দুনিয়াটা গিলবার জন্য।”
“ঠিক, ঠিক, আমার এই কথা শুনে ওনার মুখটাতেও মস্ত একটা হা দেখা দিয়েছিল। হা নিয়েই হাওয়া হলেন তিনি সেই যে, আর ফিরে এলেন না।”
“আর তৃতীয় জন?”, প্রাণপণে হাসি চেপে বলি আমি।
“সেটা তো একেবারে স্পেশাল কেস।একটা স্পেসের জন্যই সব গোলমাল হয়ে গেল।”
“শুনি শুনি, কেমন স্পেস”
“ম্যাম তো প্রথম দিন এসে আমার নিজের নাম লিখতে দিয়েই মোবাইলে চ্যাট করতে বসে গেলেন। লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হয়ে গেল, তিনি ফিরেও তাকালেন না। কফি টফি খেয়ে চলে গেলেন। নেক্সট ডে এসে বাবার নাম লিখতে দিয়ে ফের বসে গেলেন মোবাইল নিয়ে। পরের দিন মায়ের নাম। তার পরের দিন স্কুলের নাম।আর তার পরেরদিন....”
“তাঁর নিজের নাম নিশ্চয়...”
“রাইট, তুমি জানলে কি করে আঙ্কল?”, রিমির কণ্ঠায় উৎকণ্ঠা দেখলাম যেন হঠাৎ।
“আন্দাজ করতে পারছি। আর তুমি তারপর কি করেছিলে তাও বুঝতে পারছি বেশ। এবং কেন করেছিলে তাও।আগে শুনি ব্যাপারটা ভালো করে।”
“কিছুই না, আমি ওনার নাম আর টাইটেলের মাঝের স্পেসটাকে একটু আগুপিছু করে দিয়েছিলাম আর কি।”
“বটে।“
“ম্যামের নাম ছিল মধুপা দে।আমি শুধু স্পেসটা সরিয়ে মধুর পরে লাগিয়ে দিয়েছিলাম।”
“আর সেটা করেছিলি ইচ্ছা করেই, তাই তো?”
রিমির মুখটা এবার দেখার মতো হল। দুধে আলতায় আলতো রক্তিম লক্ষণ আচমকাই।মাথা নিচু করে একমনে টেবিল ক্লথটাই খুঁটতে থাকল।
“তোকে একটা কথা বলা হয়নি আমার। আজ যখন এলাম পড়াতে, তুই নাচের ক্লাসে ছিলি মনে আছে তো? পাঁচ মিনিট পর এলি। সেই পাঁচ মিনিটে আমি কিন্তু চুপ করে বসে থাকিনি মোটেও। তোর স্কুল ব্যাগ,বইয়ের র্যাক মায় তোশকের তলাটাও সার্চ করে করে দেখেছি...আর তাতেই....”
“একটা মেয়ের অ্যাবসেন্সে তার তোশকের তলা শোঁকা সেন্সেবল হয়েছে কি?”, রিমির গলায় এবার বেশ অভিমান।
“সেন্সেবল নয় শুধু, পেশেন্সেবলও বটে। বেশ ধৈর্যের কাজই ছিল সেটা। এবং এই মিশনে তোমার বাবা মায়ের পারমিশন ষোল আনাই ছিল।”
“কেন করলে ওসব আঙ্কল!”
“ বিকজ আই এম নট অনলি আ টিচার বাট অলসো ইয়োর আঙ্কল, এন্ড হ্যাভ টু প্রুভ সামথিং টু ইয়োর প্যারেন্ট।”
“কি প্রুভ করতে এপ্রুভাল দিল বাবা আবার...”
“ সেটা এই যে, বাংলাটা যে তুই ভালোই জানিস আর যেকোনও কারনেই হোক ব্যাপারটা লুকাতে চাস। আর ঐ শিক্ষক খেঁদানোর ব্যাপারটাও বোধ হয় এই কারনেই...”
“একদম না, একদম না, ওরা তিনজনেই ভালো করে পড়াচ্ছিলেন না। প্রথমজন শুধু মেক আপে বিজি থাকতেন, পরের জন খাওয়া নিয়ে আর শেষের জন ফোনে। কেউই কিছু শিখাননি আমাকে। আর তাছাড়া আই ডেসপারেটলি নিডেড এ ব্রেক।সকাল ছয়টার থেকে শুধু স্কুল প্রাইভেট ডান্স ক্লাস আর্ট ক্লাস এইসব করে করে আই ফিল ভেরি টায়ার্ড। তাই...”
“কিন্তু বেছে বেছে বাংলা ক্লাসটাকেই কেন? অন্য সব সাবজেক্টেই তো টিউটর আছে তোর। শুধু বাংলা বলেই এত হেলাফেলা?”
“হেলাফেলা করি না তো।বুল্টির সাথে আমিও বেঙ্গলি শিখি তো পুতুল মাসীর ঘরে। বুল্টিও তো একই ক্লাসে।তবে বাংলা মিডিয়াম।বুল্টি রিসাইট শেখে।আমাকেও শেখায়।আমি তার বদলে ওকে ম্যাথ্স আর ইংলিশ শেখাই। আমার আর টাইম কোথায় বল? এই শেখা আর শেখানোটাই আমার ফেভারিট টাইম পাস”
“রাজভোগগুলো তবে বুল্টির পেটেই গেছে, তাইতো? সে যাক, তবে তুই যে বাংলা পড়িস তা আমি এই দুইদিনে ভালোই বুঝেছিলাম। বড়দের বোস নয় বসুন বলতে যে জানে, সুপর্ণাকে জুতো পরাতে যে জানে, নেহা কে হা করিয়ে মধুপার পা কাটা যার কাছে এত সহজ , সে বাংলা জানে এটা আমি না বাজিয়েই বাজি ধরতে পারি, কি বল বিষ বাজিতা...
“তাই বলে ঘর সার্চ করবে? তাও আবার বাবার থেকে ওয়ারেন্ট নিয়ে?”
“সার্চ না করলে তোর বাবা জানতেন কি ভাবে যে তুই লাস্ট চারটে ক্লাস টেস্টে ফুল মার্কস পেয়েছিস বাংলায়? এবং তোর তোষকের তোষাখানা থেকে গুপ্তধনগুলো উদ্ধারই বা হত কি করে বল।”
আমি এক এক করে ওর সামনে সেই উদ্ধার হওয়া ধারদেনাগুলো রাখতে থাকি।
মন্টুর মাস্টার, অদ্বিতীয় পুরস্কার,বাড়ি থেকে পালিয়ে, পঞ্চাননের অশ্বমেধ, হাতির সঙ্গে হাতাহাতি,ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি।আরও বেশ কয়েকটা।
“এগুলোও কি বুল্টির অবদান?”
“না না এগুলো খাস দারোগা সাহেবের । বাপির বইয়ের আলমারি থেকে আলতো করে মেরে দিয়েছি।বাপি টেরও পাননি।”
“ হ্যাঁ, তোর বাবা আবার এই লেখকের খুবই ভক্ত কিনা।তাই আমার থেকেই ওই বইগুলো পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি সেই ছেলেবেলায়। তোর কল্যাণেই আজ এগুলো ফেরত পেলাম শেষে...”
রিমি ফিক করে হেসে বলল, “তা’লে বাপি দেখছি আমার থেকেও বড় চোর।ভুল করে দারোগা হয়ে গেছেন।”
“তা একরকম নিজে চুরি জানত বলেই চোর ধরতে এত পটু হয়েছে সে।”
কিছুক্ষণের নীরবতার পর রিমি বলল, “তাহলে কি ঠিক করলে আঙ্কল, আমাকে পড়াবে কি পড়াবে না?”
“তোর বাবাও রোজ রাতে এই একই প্রশ্ন করে আমাকে জ্বালিয়ে মারত। আমি তিনদিন সময় চেয়েছিলাম। আজ শেষ দিন। কিন্তু আজ আমি তোর থেকে জানতে চাইছি যে তুই আমার কাছে পড়বি কিনা। শিক্ষকের যদি ছাত্র পছন্দ করবার অধিকার থাকে, তবে ছাত্রেরও অধিকার আছে শিক্ষককে বেছে নেয়ার। বল দেখি, পড়বি আমার কাছে?”
এতক্ষণ মুখ নীচু করেই আমার সব কথা শুনছিল রিমি।এইবার ধীরে ধীরে মুখ তুলে, বেশ দৃঢ় গলাতেই বলল, “ পড়ব, পড়ব, কিন্তু....”
“ কিন্তু!!!,”
“একটা শর্ত আছে,যদি সেটা রাখো তবেই...”
“ শর্ত, বাব্বা কি শর্ত আছে বল দেখি।”
আচমকা রিমির মুখটা খুব করুণ হয়ে আসে।উজ্জ্বল চোখদুটো ছলছলিয়ে ওঠে, মৃদু গলায় বলে ওঠে, “বুল্টিকে পড়াবে গো আঙ্কল? খুব ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু ও..তবে বড় গরীব। তোমাকে হয়ত আমার বাপির মতো বেতন দিতে পারবে না ওরা...কিন্তু দেখো আমি আর বুল্টি মিলে এত ভালো করে পড়াশুনা করব যে তোমার সব খাটনি চাটনির মতোই টেস্টি লাগবে। আমরা দুজনে খুব পড়শুনা করে ডাক্তার হয়ে তোমার সব ফিজ শোধ করে দেবো প্রমিস করছি দেখো... ওরা হয়ত বাপির মতো রাজভোগ খাওয়াতে পারবে না, তবে বুল্টির মা মানে পুতুল পিসি কিন্তু খুব ভালো ইলিশ রাঁধতে পারে।তোমাকে খুব খাওয়াবে দেখে নিও। ফিজ এর ফিশ মন্দ কি আর এমন। বলোনা পড়াবে ওকে... বলোনা...”
রিমির আশাভরা ভাসা ভাসা চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকার হিম্মত আমার ছিল না।সীমাহীন ঔদার্য দেখানোর ক্ষমতা আদৌ আমার আছে কিনা ভাবতে ভাবতেই টেবিলে স্তূপাকৃতিতে থাকা গল্পের বইগুলোর দিকে চোখ গেল হঠাৎ। মন্টুর মাস্টার আর অদ্বিতীয় পুরস্কারের ফাঁকে আরও একটা মলাট উকি দিচ্ছে যেন। ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা।
মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যায়। বড়ো হয়েও মেয়েরা কিন্তু মেয়েই থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন