শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৩

সপ্তদ্বীপা অধিকারী

 একটি শবদেহের মৃত্যু অথবা





মোমের মতো আলোটা জ্বলে।মিটমিট করে।কেঁপে কেঁপে ওঠে।বেশ জীবন্ত মোম।নেভার সম্ভাবনা নেই।কিন্তু সেই আলোর ঠিকানাটা জানে না সে।জানতে চেষ্টা করে।ওই ঠিকানাটা হারায় নি।ক্ষণিকের জন্য পালিয়েছে।হয়ত কোথাও উপুড় হয়ে পড়ে আছে। জুতো জোড়া পায়ের বাইরে।মুখে অনেকগুলো মাছি।ভনভন করছে।মুখটা খোলা।শক্ত রাস্তায় নরম গাল।লাল হয়ে আছে গালের পাশ! সে জানে তাকে যেতে হবে।সে না গেলে ওই মোম উঠবে না।মোম বুঝতেও পারে না যে সে তখনো জ্বলছে।তার কানে কেউ বলেছিল যে আগুন নিভে গেলে অন্ধকার হয়। আর অন্ধকার হলে কিচ্ছু দেখা যায় না! অথচ রাই জানে আগুন নেভেনি।আগুন নেভে না এতো সহজে।

সে বইতে পড়েছে যে মানুষ মরণশীল।তাই সে যেই দেখেছে যে অক্সিজেন শেষ ব্যাস,ধরেই নিল সে আর বেঁচে নেই! এ কথা ঠিক মানুষ মরণশীল। কিন্তু কেউ কেউ বহুবার মরে।কেউ কেউ বহুবার বাঁচে! সকালে রোদ ওঠেনি বলে, সময়ে গোঁফ ওঠেনি বলে,সেল্ফি মনের মতো হয়নি বলে কিংবা গরুতে হাম্বা বলেছে বলে অথবা বলেনি বলে তিন লক্ষ সাত হাজার সাতশ নিরানব্বইজনকে আত্মহত্যা করতে দেখেছে রাই।আত্মহত্যা করার আগে প্রত্যেকে যে যেমন অস্ত্র পেয়েছে তেমন অস্ত্র দিয়ে নিজেদের  শরীরটা অনেকগুলো টুকরো করে কেটেছে! আর আত্মহত্যা করার পর পকেট থেকে রুমাল বার করে নিজের শরীরের বিভিন্ন টুকরোগুলো থেকে হার্টটা বার করে রুমাল দিয়ে জড়িয়েমড়িয়ে হাতে ধরে বসেছিল।রাইএর অদ্ভুত লাগে।সে জানে যে ওই মোমের আলো নিজে জানে যে সে নিজের হার্টটা নিজেরই পকেটের রুমাল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। বাঁচবে বলে।অথচ সে কিছুতেই বিশ্বাস করছে না যে সে নিজে বেঁচে আছে।হার্টের রক্তে ভিজে যাওয়া রুমালটা একটা কুকুর এসে শুঁকছে।বারবার। কুকুর মাংসাশী। তাই শুঁকছে।কুকুরের ঘ্রাণশক্তি প্রবল।তাই শুঁকছে। কিন্তু খাচ্ছে না।লেজ নেড়ে নেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে। কিছু পরে আবার ফিরে আসছে।এবং একই কাজ করে আবার দূরে সরে যাচ্ছে।ঠিকানা না জানলে কোনো জীবন্ত মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না।ঠিকানা না জানলে একটা মৃত শরীরকেও খুঁজে পাওয়া যায় না! কিন্তু যে শরীরটা নিজে শব হয়েও পাথরের রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে আছে,রাই কী যেন এক দায় নিয়ে সেই শরীরটা খুঁজে চলেছে। 

এই যেমন সেদিন রেল লাইনের পশ্চিমদিকের ময়লা ফেলার বাক্সের মধ্যে একটা মানুষের বাচ্চার কান্না শুনে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল।রাই ভাবল এই সুযোগ।কতবার আর সে দিগভ্রষ্ট হবে?? অনেকের মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেও অনেকেই শোনেন।তাই রাই এই ভিড়টাকেই বেছে নিল। সেও চলল। ভিড়ের মধ্যে অনেক লোক গিজগিজ করছে।দূর থেকে দেখতে পেল রাই।কাছে গিয়েই সে উটের মতো ঘাড় উঁচু করে দেখতে চাইল।সে কি এইখানে?? এইখানেই কি পড়ে আছে?? ভিড়ের মধ্যে ঢুকেই সে সামনেই তাকে পেয়ে গেল! রাই তার হাত দুটো ধরেই বলে ফেলল--"সুতির সাদা রুমাল জড়ানো লাল বস্তুটা আমার!" বলেই সে দেখল শিয়ালের মতো জ্বলে উঠল লোকটার দুটো চোখ।আর রাইএর ভিতরে জ্বলে উঠল মোমবাতিটা।কাঁপছে তিরতির করে। রাই যেমন এসেছিল ঠিক তেমন ভুল পথেই ফিরে গেল!

রাইএর ছোটা দেখে কতোগুলো মানুষ কুকুরের মতো তাকে অনুসরণ করল।কিন্তু রাই নিজেই নিজের বুকের মধ্যে তখন ঢুকে পড়ে।আর তাকে কেউই খুঁজে পায় না! 

পথের মধ্যেই পড়ে থাকে রাই একখণ্ড পাথর হয়ে।

জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে থেকে সেই মানুষগুলো,যাঁরা রাইকে চেনেন তাঁরা বললেন --"রাম রাম,রাম রাম!"

অচেনা লোকেরা বল্লেন--"কী হয়েছে??"

চেনা লোকগুলো বললেন--"ওই যে মেয়েটাকে দেখলেন,ও তিন বছর আগে আত্মহত্যা করেছিল গলায় দড়ি দিয়ে।কিন্তু তারপর...রাম রাম রাম রাম...!"

পুরোটা না জেনেও সব্বাই কপালে হাত ঠেকান। বলেন---"রাম,রাম,রাম,রাম...!"

আবার ভয় ভয় কণ্ঠে অস্ফুটে বলেন---"তারপর!??"

চেনা লোকগুলো বলেন---"মাঝে মাঝে তাকে দেখা যায়! তার কথা কেউ শুনতে পায় না।কিন্তু সে কিছু একটা বলেই পিছন ফিরে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়...!"

সবাই বলেন---"রাম,রাম,রাম,রাম...!"

জনসমাগম কমে গেলে রাই আবার বের হয়।আবার চলতে থাকে।আবার খোঁজ নেয়।আবার কোথাও কালো মাথা দেখে এগিয়ে যায়।আবার নিজেকে প্রকাশ করে।আবার নিজের চাহিদা জানায়।আর বারে বারে তার ভিতর থেকে কেউ তাকে সাবধান করে --" পালা রাই..., পালা।রাই পালা...!"

রাই ছোটে আর একেকবার পিছন ফিরে দেখে।"সত্যিই ভুলটা ভুলই তো??"

এখন খিদে ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি বাকি নেই রাইএর।সে আর খোঁজ করবে না, ভাবে।যায়ও না কোথাও কাউকে খুঁজতে।সে ভাবে কখনো কেউ এসে কি তাকে বলবে না  যে, এই নাও রুমাল। দেখে নাও এ-ই রুমালটাই সুতির।এবং এর ভিতরেই আছে আমার লাল রক্তের হৃদপিণ্ডটা। 

একদিন রাইকে একটা অপরিচিত লোক তার নিজের  মাথা নুইয়ে বলল--"আমি জানি সে কোথায়!"

রাই বলল--"কোথায় গো?? কোথায়??"

লোকটা বলল--"এই দেখ,আমার টুপির তলায়!" বলে সে নিজের মাথার টুপি খুলল।রাই দেখল টাক মাথা।

রাই বলল--" রুমাল না থাকলে হবে না!"

লোকটা বলল--"কে বলেছে হবে না?? চেষ্টা করতে ক্ষতি কী??" 

রাই বলল--"কীসের চেষ্টা?? আপনাকে তো চিনিই না।আপনার সাথে এসব নিয়ে কথা বলার কোনো দরকারও দেখছি না!"

লোকটা চলে যায়।কিন্তু রাইএর বিশ্বাস হয় না।সে বারবার উঁকি দিয়ে দেখে।

সেদিন রাত তখন দুটো বাজে।রাই তার বেড রুমে সেই টাক ঢাকা টুপিওয়ালাকে দেখল।রাই চিৎকার করে উঠল।লোকটা টেনে হিঁচড়ে রাইএর শাড়ি টাড়ি খুলে ফেলল। তারপর মুখের মধ্যে মুখ দিয়ে জোরে জোরে টেনে টেনে রাইএর ভিতরের সমস্ত অস্থি-মজ্জা বের করে আনল।রাই বলল--"এমন কেন করলে?? এমন করে কেউ নি:স্ব করে??"

টাক ঢাকা লোকটা বলল--"এইটাই করা উচিত ছিল অনেক অনেক বছর আগে!তাহলে একজন জীবন্ত মানুষকে আর ভূত বলে অন্যেরা ভয় পেতো না...! আরো একটা কথা যে যাবার সে গেছে।তাকে যেতে দাও! নিজের দিকে চেয়ে দেখো...! তুমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ! একজন পূর্ণ নারী তুমি..!"

বলে রাইএর শরীরের উপর থেকে নেমে পড়ল।

বলল--"তোর ভিতরের সব কলকব্জা পালটে দিয়েছি।এবার দেখ তুই যাকে খুঁজছিস তাকে ঠিক পেয়ে যাবি!"

একসময় সকাল হল।রাই এক তুমুল ভয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল না।

নিজেকে নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল! টুপি পরা লোকটা বলে গেছে এবার সে তাকে পাবে।সে বিশ্বাস করে।এবার সে পাবে!

কিন্তু চরম মুহূর্তে রাইএর যে সঠিক কথাটাই মনে পড়ে না! আর মোমবাতি জ্বলে।অজানা জায়গায়! আর কাঁপে যে তার শিখা! ঠিক সেইসময় তার ভিতরে কেউ তাড়া করে আর কেউ বলে --"রাই পালা...! পালা রাই!"

রাই তবুও উঠল।তবুও কলসি কাঁখে তুলল।তবুও কদমতলে গেল।এবং এতগুলো কাল  অভিমানে একা একা কাটিয়েও   অবশেষে রাই তার দেখা পেল।তার মনের গহনে জ্বলে উঠল মিটিমিটি আলো।রাই হাত জোড় করে বলল--"যেও না মথুরায়...! এই  একটা জীবনে অন্তত কাছে থাকো আমার...!"

চমকে ওঠে সেই পুরুষ! বলে ওঠে---"এতোদিন কোথায় ছিলে??"

বলে--"তোমার সাথে আমার চাঁদনি রাতে দেখা হয়েছিল।দেখা হয়েছিল নিরেট অন্ধকারেও।তোমাকে পেয়েছিলাম যখন,তখন পৃথিবীতে কোনো কাল ছিল না,অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলে কোনো কিছু ছিল না,ভালো-মন্দও ছিল না,আশা-নিরাশার মৃত্যু ঘটেছিল তখন।বেঁচেছিলাম শুধু তুমি আর আমি।আমি তোমায় ঠিক চিনেছিলাম।কিন্তু তুমি চেনো নি!"

কোথায় মেঘ ডাকে।সিংহের মতো গর্জন করে ওঠে! গরগরগরগর...! হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে আমূল ভিজতে থাকে দুইজন।ভিজতে ভিজতে ভিজতে ভিজতে রাই তার বুকের ভিতরে তার প্রিয়তমের হৃদপিণ্ড অনুভব করে! 

আর তার নিজেরটা সে খুঁজেও পায় না!

অথচ তীব্র বাঁচার আশায় দুজনেই দুজনকে আঁকড়ে ধরে থাকে!





1 টি মন্তব্য:

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...