দায়ভার
"বাবু! দু'টো টাকা দিবি? সকাল থেকে কিছু খাইনি! "
প্রত্যাশার হাতটা বাড়িয়ে চোখমুখ কুঁচকে সামনে এসে
দাঁড়িয়েছে বছর চোদ্দ পনেরোর একটা মেয়ে। কমনীয়তায় ভরা মিষ্টি চেহারার মেয়েটাকে এর
আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হলো না। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। পরনের স্যালওয়ার কামিজ
দেখে বেশ ভদ্রঘরের বলেই মনে হলো। না জানি কোন বাবামায়ের বুক খালি করে দিয়ে এসেছে।
অফিসের ব্যস্ততায় কোন কথা না বাড়িয়ে পকেট হাতড়ে দু'টো টাকা বের করে দিয়ে চলে এলাম।
সেই হলো জ্বালা। নিত্যদিনের আমার অফিসের পথে ষ্টেশনের গেটের ধারে, প্রতিদিনই ওভাবে
দাঁড়িয়ে দু'এক টাকা আদায় করে ছাড়ে। কোনদিন দেই, কোনদিন দিই না। ছা-পোষা কেরানী
জীবনে এ এক উটকো ঝামেলা।
ভৈরব নদের পাড়ে ষ্টিমার ঘাটের পাশে এই রেলওয়ে ষ্টেশন। প্রতিনিয়তঃ কত রকমের
উদ্বাস্তু, ফকির আর পাগলের সমাগম হয় এখানে। কে কখন কোথা থেকে আসে, আবার কে কখন কোথায়
হারিয়ে যায় কে তার খোঁজ রাখে? প্রতিবছর বানভাসী মানুষ আসে দক্ষিনাঞ্চল থেকে ষ্টিমারে
চড়ে। আর মঙ্গার দেশ, উত্তরাঞ্চল থেকে আসে লোকাল ট্রেনে চেপে। কাজকর্ম হীন মানুষগুলো
শহরের দিকভ্রান্ত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। অনোন্যপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি
করে পেট ভরায় আর খোলা প্লাটফরমে গুড়িমেরে পড়ে থাকে। নির্দ্ধারিত অথবা নিদ্দিষ্ট কোন
কাজের সন্ধান যতদিনে না হয়; সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলো এখানেই ঠাঁই নেয় প্রাথমিকভাবে।
তারপর একসময় বিশাল জন-সমুদ্রে হারিয়ে যায়। এদের কেউ কেউ কাজের খোঁজে কুলিকামিন বা রিক্সা,ভ্যান
চালক হয়ে যায়। অথবা কাজের অভাবে ঘরের সোমত্ত মেয়ে-বউগুলো জঠর-জ্বালা মেটাতে দেহ-ব্যবসায় নেমে পড়ে। যে ক'টা
দিন ভাসমান জীবনের এই রেলওয়ে প্লাটফরমে পড়ে থাকে, সে ক'টা দিন রেলপুলিশের লাঠিপেটা
আর অসভ্য লোলুপ-কামুক দৃষ্টিতে তটস্থ হয়ে থাকে সানাক্ষণ। তারপর কিছু একটা হিল্লে হলেই
এরা চলে যায় দূরে কোথাও। এ দৃশ্য আজ প্রায় দশ বছর দেখে আসছি। আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, নতুন কোন উদ্বাস্তু
এখানে এলে, পুরাতন যারা এখানে থাকে তারাই দু'একদিন চেয়েচিন্তে নিয়ে এসে এদেরকে খাওয়ানোর
ব্যবস্থা করে থাকে। সত্যিই বিচিত্র মানুষের মন। কত রকমের পাগলামী একেক মানুষজনের মানসিকতায়।
পাগলের প্রসংঙ্গ এলো তো বলি, নতুন পাগলরা ষ্টেশনে এলে, কখনও কোন কারণেই তারা
প্লাটফরম ছেড়ে যায় না দূরে কোথাও। সম্ভবতঃ ওদের মনে কোন একটা ভয় কাজ করে, ' দূরে
গেলে যদি হারিয়ে যায়! '
তারপরও কিছুদিন পর আর কাউকে দেখা যায় না। নতুন কেউ এসে হাজির হয় ; প্রকৃতির
পালা বদলের মত।
মেয়েটার সাহস ইদানিং একটু বেড়েছে বোধহয়। আমার অফিসের খোঁজ
কিভাবে পেয়েছে জানি না। দরজার সামনে এসে বসে থাকে প্রায়শঃ। কোন কথা বলে না, শুধু
খিদে লাগলে দু'টো টাকার দাবী নিয়ে এগিয়ে আসে। পরনের পোষাকে নোংরা গন্ধ ছড়াচ্ছে।
চুলে ধুলো ময়লা জমে জট পাকিয়েছে। দেখে মনে কষ্ট হয়। ক'টা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলি, '
মাথার চুল কাটাবি আর সাবান কিনে কাপড় পরিস্কার করবি। '
এরপর হয়তো দু'পাঁচ দিন আর দেখা নেই,
কোথায় ডুব মারে কে জানে?
উদাসী দিনের অবসরে, কর্মব্যস্ততাহীন সময়ে জানালার ফাঁক গলে
দূরের লঞ্চঘাটের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে, শূন্যদৃষ্টি মেলে দিয়ে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই।
একাকিত্ব জীবনে এসে মনে করবার চেষ্টা করি, আমাদের একটা একান্নবর্তী পরিবার ছিলো।
বাবা ছিলো, মা ছিলো। ভাই ছিলো, বোন ছিলো...।
এই যে মেয়েটা ; এই মেয়েটার বয়সী আমার একটা আদরের বোন ছিলো। যে বোনটা একদিন বড্ড।অভিমান করে হারিয়ে গেলো ; যে
জগৎ থেকে কেউ আর ফিরে আসে না কখনও, কোনদিন। আমরা এতোটাই হতভাগ্য যে, সেই ছোট্ট একরত্তি
মেয়েটার অভিমানের কোন মূল্য দিই নি। সত্যিই, পৃথিবীতে অভিমানের মূল্য কেউ দেয় না কখনও।
মনে পড়ে, বোনটা কষ্ট পেলে অভিমানে দু'ঠোঁট ফুঁলিয়ে কাঁদতো। বহুদিন পর সেসব স্মৃতি আজ
আমার দু'চোখের দৃষ্টি ঝাঁপসা করে দেয়। চাপা দীর্ঘশ্বাস মনের অজান্তে হুস্ করে বেরিয়ে
আসে সান্টিং এঞ্জিনের বাস্পবাতাস হয়ে।
কতদিন ভেবেছি, এই অনাথ মেয়েটাকে নিজের কাছে রেখে দিই বোনের
মমতায়। তারপরও সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমাদের এই সমাজে কোন পরিচয়ে নামগোত্রহীন মেয়েটাকে
কোন অধিকারে ধরে রাখবো? সভ্য সমাজে ছ্যাঁ ছ্যাঁ পড়ে যাবে। দূর্নামে রটে যাবে আমার
পরিচিত।মহল। তারচেয়ে সে যেখানে আছে যেভাবে থাক ভালো থাকুক। মনকে শান্তনা
দিই,'দায়ভার নেয়ার আমি কে?'
মাস ছয়েকের জন্য অন্যত্র বদলী করা হলো আমাকে। আমার জায়গাতে
যে ভদ্রলোক এলো, সব কাজের দায়ভার তাকে বুঝিয়ে দিলাম। যাওয়ার দিন মেয়েটাকে দেখিয়ে
দিয়ে আমার সহকর্মীকে বলে গেলাম, 'এই অনাথ মেয়েটাকে মাঝেমধ্যে কিছু খেতে দিও। আর
খেয়াল রেখো, দুষ্টু কোন লোকের পাল্লায় যেন না পড়ে। জিআরপি রা অবশ্য ওদের
ব্যারাকের।কাজের মাসীর।সাথে থাকতে দেয়। ফাইফরমাস
খাটে, চেয়েচিন্তে খায়। " বন্ধুর সম্মতিতে স্বস্তি পেলাম।
সময়ের সাথে সাথে তালে তাল মেলাতে মেলাতে একদিন আমিও ওই
মেয়েটার কথা ভুলে গেলাম। মাস ছয়েক পর আমি আবার পুরোনো কর্মস্থলে ফিরে এসেছি।
অফিসের কাজের দায়ভার বুঝে নেয়া এবং।সেইসাথে নিজের ব্যক্তিগত কাজে আমি এখন
দিশাহারা। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন একজন আসবে আমার জীবনের সাতরঙে রঙিন হয়ে ভাসতে।
সেই খুশিতে আমিও ভাসছি। ঠিক সেই সময়ে, দুপুরের একটু আগে মেয়েটা এলো।
"বাবু! খিদে পেয়েছে! "
চেয়ে দেখি মেয়েটার চেহারাটা কেমন মলিন, রুক্ষসুক্ষ আর গায়ে-গতরে বেড়ে উঠেছে।
গোটা পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, যা রুটি খেয়ে নিস।"
হি হি করে দাঁত বের করে এলোমেলো পায়ে চলে গেলো।
অফিস-রুমেই টিফিন সেরে ভাতঘুম দিচ্ছি চেয়ারে বসে বসে। তন্দ্রার মধ্যেই টের
পেয়েছি মহানন্দা ট্রেনটা এসে ঢুকেছে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে।
রেলওয়ের কুলি ছেলেটা এসে বললো, "বাবু! কেবিনের ধারে
ক্রসিং পয়েন্টে ওই মাইয়াডা কাডা পরছে! লন দেইখ্যা আহি। "
শরীরে মেরুদন্ডের ভেতরে কেমন যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো মুর্ত-আর্তনাদে।
যেয়ে দেখি দেহটা তিন চার টুকরো হয়ে আছে। নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। ট্রেনে
কাটা মানুষের শরীর থেকে কোন রক্ত বের হয় না। থ্যাৎলানো মাংসপিন্ড গুলোকে জড়ো করছে জিআরপি'র
মুদ্দাফরাস। সদ্য খাওয়া রুটি-তরকারি ছটকে গেছে। কেটে যাওয়া মুন্ডুটার দিকে সকরুণ তাকিয়ে
দেখি নিঃস্পাপ হাসিটা লেগে আছে এখনও মেয়েটার মুখে। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হলো। যদি
আমি ওকে রুটি খাওয়ানোর টাকাটা না দিতাম ; হয়তোবা অসময়ে সে হোটেল থেকে খেয়ে ফিরতো না।
আর এভাবে মরতেও হতো না তাকে।
লাঠির ডগায় একটা কিছু উল্টিয়ে দিয়ে পুলিশের এক কনেষ্টবল
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো " অর
প্যাডে দেহি একটা পোলাপাইন! কার লগে যে আকাম করছেলে হ্যা কইতে পারো? "
কার উদ্দেশ্যে তার সে উক্তি কে জানে? ঘৃনায় আমার মন কুঁচকে এলো, "
ছিঃ! মেয়েটা তাহলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো? কী দরকার ছিলো এভাবে নষ্ট হওয়ার- ? "
কুলি ছেলেটা বললো," জানেন বাবু! আপনার অপিসের হেই বাবুডা এই ছেঁমরীরে নষ্ট করছেলে! "
আমি যেন আর কিছুই শুনতে পারছি না। বানের জলে ভেসে আসা নাম
পরিচয়হীন অনাথ বালিকা ; দু'মুঠো ভাতের জন্য হা-পিত্তেশ করে বেড়াতো। যার ছোট্ট একটা
জীবনে চাওয়া পাওয়ার কিছুই ছিলো না। শুধু দু'টো রুটিতে যার স্বপ্ন ঘেরা থাকতো। এই
সভ্য (?) সমাজের মানুষ হয়ে আমরা তাকে কতটুকু সুখি হতে দিয়েছি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন