বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

অর্ঘ্য দে

জোকার সিরিজ

 

 

 


 

এক

 

 

 

    মার্কশিটে অঙ্কে চৌত্রিশের অনড় ছায়া ঢেকে দিত হরপ্পা, চিলকা হ্রদ। লঘু হয়ে যেত আমার অক্সিজেনের ঘনত্ব। নতি কোণ বেয়ে অবেলায় জ্বর নামত আমার গায়ে। শুয়ে শুয়ে দেখতাম বাগানে কলসপত্রী খেয়ে ফেলত পিঁপড়ে, পোকা। আজকাল কোনও হিসেবেই আর মেলে না! বারবার খাতা খুলে বসি, নিঝুম দুপুর পেরিয়ে খেলার বিকেল। সেই বিকেলে দেখি মায়েরা খেলছে ছেলে মেয়েদের সাথে। কেউ কেউ গ্যাস বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছে। বলের মতো বিকেল গড়াতে গড়াতে সন্ধে নামে ঘাসের বুকে। বাকি থেকে যায় কত গল্প, খেলার হিসেব।

 

 

 

    আমার হিসেবের খাতায় রাত নামে আলোহীন। জোকারের মিশকালো জোব্বার মতো দীর্ঘ, থমথমে। এমনই অমারাত্রিতে বসে থাকতাম রোয়াকে। তুমি আসতে না। অথচ তুমি এলেই মিলে যেতে পারত অঙ্ক। অনন্ত এই বসে থাকা। ক্যালেন্ডারের পাতায় বৈশাখী মেঘ, বৃষ্টি, রোদ, উত্তরের হাওয়া—এক একটা অধ্যায়ের মতো শেষ হয়ে যায়। ঝুপসি শিরীষবনে শ্রী খোলের সঙ্গতে বিরামহীন শ্মশানসঙ্গীত। প্রেত হাওয়ায় ডুকরে কেঁদে ওঠে সদ্য বিধবা মেয়েটি। রতিক্লান্ত ভ্রমরের গান শুনতে শুনতে একাদশীর ফলের খোসা ছাড়ায়। স্থির বিশ্বাসে খোঁজে বেঁচে থাকার মানে। 

 

 

 

    আসলে অনেক আগেই বেঁকে গেছে জীবনের সরল রেখা। আজকাল স্বপ্নে আসে না মেঠো পথ, বট অশথের স্থির প্রশস্ত ছায়া। বুনোডুমুরের ঝাঁকে ছাতারে পাখিদের নাচানাচি নেই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বিলের ধারে ছিপ ফেলে যে অপরিচিত ছেলেটা বসে থাকত সেও আর আসে না। বিলে পানকৌড়ির ডুব দেয়ার শব্দের ভিতর হয়তো ছিপ গুটিয়ে খালি হাতে ফিরে গেছে। বাড়ির সকলের মুখে মাছ তুলে দিতে না পারার কষ্টে ছেলেটার ভিতর জন্ম নিয়েছে পুড়ে যাওয়া একটা বাবলা গাছ। আমি তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই। অসীম শূন্যতায় জেগে আছে রক্তশূন্য কিছু চোখ। যারা যোগ বিয়োগের গোলকধাঁধায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, অথচ একদিন সেই সব চোখে ছিল শায়রের স্বচ্ছ গভীরতা। নীল-বেগুনি শালুকের আভা।

 

 

 

    সাদা-কালো বিকেলে জিগ-স পাজে়ল সাজিয়ে আমার সামনে রেখে দেয় ধবধবে জোকার। গায়ের মিশকালো জোব্বার ভিতর বুক দেখা যায়। শুকনো হাড়ের মতো সাদা। অনেক বসন্ত পুড়ে এমন বিবর্ণতার জন্ম হয়। যেন সেখানে খেলা করছে কত বছরের রক্তশূন্যতা। প্রেম, প্রতিশ্রুতির বিন্দুমাত্র কোনও রঙ নেই সেখানে। হাসিতে প্রহসন। আমার গা-জ্বালা করে। আমি পাজে়ল জুড়তেই জিলিপির প্যাঁচের ভিতর দিয়ে সূর্য ডুবে যেতে দেখি।



দুই

 

    কোনও কোনও অঘ্রানে এমনই ঘন মেঘ করে। সামনে যতদূর চোখ যায় বিষণ্ণতা, ধোঁয়াশা। এই ধোঁয়াশা ঠেলে ছেলেবেলা ফিরে আসতে চাইলেও পারে না। মনে মনে ভাবি এই ধোঁয়ার বলয় দাঁতে কেটে ছিন্ন করে একবার যদি বেরিয়ে আসে কুট্টুস, রহস্যভেদী টিনটিন। আমার স্মৃতিতে তখন কমিক্সের ঘূর্ণাবর্ত, অস্থিরতা। নিউরোনের অ্যাক্সন থেকে ডেন্ড্রনে লাফ মাড়ে রংবাহারি নায়কেরা। জোকার সাইন্যাপ্স ছিন্ন করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে।

 

 

 

     জলাশয় বুজে আসছিল মরা মানুষের চোখের মতো। খুন হয়ে যাচ্ছিল বসন্তবৌরি, মাছরাঙা। জোকার সেই সব মৃত পাখিদের ঝলমলে পালক ওড়াচ্ছিল। মেঘরঙা দুপুরে লেপের তলায় রঙিন পালকের স্বপ্ন দেখছিলে। সার্কাসের মঞ্চে যেন পরীর দল নেমে আসছে। 

 

 

 

     ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের দুপুরে আমার দুয়ারে একটা গর্ভবতী ছাগলের মৃত্যু তুমি দেখতে পাওনি। মনিব লোকটা ছাগলের সিং ধরে কয়েকবার নাড়ায়। ঝাপসা চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গামছায় চোখ মুছতে মুছতে ভ্যান ঠেলে লোকটি মেঘলা দিনের ভিতর কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

 

    দেখতে দেখতে মনে হল এভাবেই তো হারিয়ে যায় ছেলেবেলা।

 

 

 

তিন

 

 

 

    কাঁঠালতলায় পুরনো টিনের ছাউনিতে একটা প্রত্ন ভ্যানসাইকেল, নিতান্ত অবহেলায় পড়ে ছিল। তাকে ঘিরে ঘনিয়ে উঠেছিল অন্ধকার। অপরিমেয় সেই অন্ধকার।  

 

    দীর্ঘ অবসরের পর জং আর অলসতা ভেঙে গড়িয়ে গেল। বোঝাই করে নবান্নের ধান। পথের ধারে হা-ভাতেদের ঘর, আমন ধানের ছায়া পড়ে। সেই ছায়ায় ছোটাছুটি করছে বাড়ন্ত শৈশব। তামাটে রঙের রুক্ষ মানুষগুলোর গায়ে সোনা রোদের জরি। চোখে পঞ্চমী সুর। নরম রোদের অল্পনায় আমার ঘ্রাণে অফুরন্ত অঘ্রান। কয়েকটা চড়ুই পাখি উড়ে গেল কড়ি বরগার ফাঁক থেকে।

 

    দীর্ঘ দিন পর আজকে জোকার হেরে গেল।

 

  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...