বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

রাখী নাথ কর্মকার

 

মা, তোমাকে



 

প্রিয় মাম,      

 

আজ এই প্রথম আমি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি।  নাহ, এর আগেও অবশ্য কোনোদিনই আমি তোমাকে কিছু লিখিনি।  না চিঠি, না চিরকুট। প্রয়োজনও পড়েনি!  কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, আমার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে তোমার জন্যে লিখে রেখে যাই কিছু অব্যক্ত স্বপ্নের উইল।  ইচ্ছে হচ্ছে, পুরোন বইএর তাকে থাকে থাকে চাপা পড়ে যাওয়া বিস্মৃত গল্পের মত আমার জমে থাকা ভারি কথাগুলোর চঞ্চল শব্দহীনতাটুকু অকপটে তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিই ! ঠিক তুমি যেমন ভাগ করে নিতে তোমার মিঠে আনন্দের আমেজটুকু - আমার সঙ্গে । ব্যালকনিতে সোনালী রোদ্দুরে ফুলভারে ঝুঁকে পড়া ঝলমলে সাদা গোলাপসুন্দরীর খুশীর মতন! তবে ছলছলে আষাঢ়ে মেঘরাশির মতো ভারী, তেতো দুঃখের ভাগটুকু কিন্তু তুমি আমায় কখনো দিতে চাওনি, আমি জোর করে চাইলেও না। অথচ দেখো, সেই তিতকুটে, আঠালো বিষাদটুকুই আজ ছড়িয়ে আছে আমার একঘেঁয়ে, একরঙ্গা দিনযাপনের যান্ত্রিকতার আনাচেকানাচে!                         

এখন গভীর রাত। খানিক আগেই বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। লাল হয়ে আছে শ্রাবণের আকাশ। তুমি জানো মাম, আমার খুব সাধ ছিল একখানি মেঘরঙ্গা উড়নির।  ঝলমলে রূপোলী চুমকিতারায় সাজানো। ঠিক যেমন এখন শ্রাবণ আকাশ তার আহত, অবাধ্য বুকের উথালপাতাল ঢেকে রেখেছে ঐ মেঘলা উড়নি দিয়ে। আকাশের দিকে না তাকিয়েই কিন্তু তুমি ঝিলিকতারার আকাশ খুঁজে পাবে মাম - ঐ উড়নির মাঝে ! আর খুঁজে পাবে চুমকিআয়নায় নিথর হয়ে যাওয়া মস্ত একখানি চাঁদ। তুমি কিন্তু আমার এই ইচ্ছে শুনে সেদিন বৈশাখের নিদাঘ রুদ্ররোষে আমার দিকে চেয়েছিলে!   

বড় সাধ ছিল আমার হলুদ অমলতাসের মত ঝিরঝিরিয়ে ঝুলে পড়া একজোড়া সোনালী ঝুমকোর - ঠিক যেমন ঝুমকোয় মিঠিদিদিকে তুমি সাজিয়ে দিয়েছিলে ওর বিয়ের সময়। তুমি তা জানতে পেরে সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলে আমার দিকে ।    

ইচ্ছে ছিল আমার, ইতিহাসের রহস্যময় অন্ধকার ছেনে তুলে আনব অজানা মণিমুক্তোর সম্ভার। তুমি ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলে-“তুমি ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনীয়ার হবে! মেয়েদের মত ইতিহাস নিয়ে টিচারি করবে শেষে?”   

মিঠিদিদির রংচটা, ভাঙাচোরা বার্বিগুলো, ওদের হলুদ ফুলছাপা স্কার্ট, ভ্যানিটি ব্যাগ - সব সব লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি আমার একাকী টেবিলের গোপন কোণায় পুরোন স্কুলব্যাগে। তোমার সাথে খেলতে চেয়েছি কতবার মিঠিদিদির ফুলো ফুলো ব্রাউনি টেডিটাকে নিয়ে। তুমি আর পাঁচটা ছেলের মতই আমার ঝুলি উপুড় করে দিয়েছিলে ট্রেন, বাস, বিল্ডিং ব্লকস, লেগো দিয়ে!    

 

আসলে আমার স্বপ্নটা ছিল বড়ই অদ্ভুত! অন্তত তোমার চোখে, তোমাদের সবার চোখে! আমার এই পুরুষালি শরীরের মিথ্যে খাঁচা থেকে মুক্ত করে এনে, পাঁপড়ি সরিয়ে দিয়ে জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি আমার চিরচেনা মেয়েলি প্রাণখানির সৌরভ!   

তুমি আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বলেছিলে-“এসব কি বলছ কী তুমি অরণ্য? তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান! এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে কী করে? এ নিশ্চয়ই তোমার ঐসব অনলাইন গেম খেলার ফল-রাতদিন কম্পিউটার নিয়ে পড়ে আছ! গেমের ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে এবার  রিয়েল দুনিয়ায় বেরিয়ে এস দেখি!”  

তুমি বোঝ না মাম, গেমের ঝকঝকে দুনিয়াটা কিন্তু ঐ ল্যাপটপএর ওপারেই ফেলে রেখে আসি আমি রোজ। সঙ্গে শুধু নিয়ে আসি এক ধূসর বিষণ্ণতা, ঠিক যেমনটি লুকিয়ে থাকে সন্ধ্যেশেষের জমাট অন্ধকারের মধ্যে। সেই বিষণ্ণতা বারে বারে আমায় মনে করিয়ে দেয় আমার সামনে অপেক্ষা করছে এক সুদীর্ঘ রাত। অস্থির, ছটপটে ঘুমও প্রায়ই স্বল্পায়ু হয়ে যায় যার কাছে ! ঘড়ির ক্লান্তিকর টিকটিকানির স্পন্দনে ভাবনাগুলো থিতিয়ে রেখে তারপর রোজ সকালে শুরু হয় আমার আর এক দীর্ঘ অপেক্ষা।     

মাম, তোমার মনে পড়ে - পাঁচ বছর বয়স থেকেই আমি তোমার কাছে আবদার করে এসেছি - ঝিরঝিরে গোলাপী লেস দেওয়া রুমাল; ফুল ফুল মোজা;  পরীর ডানাভাঁজে আটকে থাকা টুকটুকে পেনসিল ব্যাগ;  সোনালি চুলের বার্বি! তুমি বিহ্বল ঔদাসীন্যে আমায় এনে দিয়েছ স্পাইডারম্যান হ্যাঙ্কি; স্ট্রাইপড মোজা; বেন টেন পেনসিল ব্যাগ; দামী রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার। আমি যখন থার্টিন - তেরোর কুঁড়ির বাঁধন আলগা হয়ে আসতে শুরু করেছে, পরতে পরতে পাঁপড়ি খুলতে শুরু করেছে অমোঘ বসন্ত। তখন দ্বিধার আঁধার কাটিয়ে স্পষ্ট বুঝলাম আমি –আমি আর পাঁচটা ছেলের মতো নই, হতেও চাই না!     

 জানো মাম, তারপর কতগুলো একাকী রাত আমার বালিশ ভিজে চুপসি হয়ে গেছে, কতগুলো নিরালা দুপুর সাজানো বৃষ্টির অছিলায় ঝরঝরিয়ে কেঁদেছি আমি - যখন ঐ শব্দটার মানে জানতে পারলাম আমি! এক একসময় তো আমার মনে হত - শব্দটার মানে না বুঝতে পারলেই বোধহয় ভাল হত। এতোগুলো বছরের টানা সেই কনফিউশন, বিভ্রান্তির শেষে সেদিন যখন সঙ্গীহীন, বন্ধুহীন বিকেলে আমার আমিকে তোমার কাছে মেলে ধরেছিলাম, তুমি অন্ধকার চোখে চেয়ে বলেছিলে -“এ সব তোমার পাগলামি! তোমার মনের ভুল। এ হয় না, হতে পারে না।” তোমার নেগেটিভ নিঃশ্বাসে ঝলসে উঠেছিল তীব্র প্রত্যাখ্যান । তুমি আমায় স্বীকার করোনি। বোঝোনি, বুঝতে চাওনি। 

ভগবান তো শুনেছি কখনো ভুল করেন না, তাহলে কি আমিই ভুল?

আমি তো কখনোই, কোনোদিনই আর পুরোপুরি আরেকটি মিঠিদিদি হয়ে উঠতে পারব না মাম..!  সম্পূর্ণ অরণ্য ? তাও নয় !

 

আমার শরীরে মনে সারাক্ষণ বয়ে চলেছে অদ্ভুত এক চোরাটান। একটা অসম্পূর্ণতার বোধ যেন আমাকে জড়িয়ে থাকে সবসময়, শীতের ভোরের দুর্ভেদ্য ধোঁয়াশার মত। বাহ্যিক কোনো কিছুই এখন আর আলাদা করে প্রাধান্য পায় না আমার মনের মাঝে। ঐ সর্বগ্রাসী অস্তিত্বটুকু ছাড়া।     

 

আমার সমস্ত আবেগ জমাট বেঁধে এসেছে আজ হতাশ রাত্রির আনাচেকানাচে । গত কয়েক মাস ধরেই একটু একটু করে তিলে তিলে সরিয়েছি আমি, জমিয়েছি তোমার স্লিপিং পিলসের মুক্তোদানা। এবার হয়ত হঠাৎ খসে পড়া নামহীন সতেজ শিউলির মত দীর্ঘশ্বাস ফেলে একা একাই হারিয়ে যাব অভিযোগহীন বিস্মৃতির দুনিয়ায়। ভার্চুয়াল গেমের দুনিয়াটা কি এর চেয়েও মোহময়ী মাম?    

 

আজ, পৃথিবী আমার স্বপ্নের ওঠাপড়া নিয়ে কতখানি ভাঁজ ফেলবে তার কপালে, তা নিয়ে আমি এখন আর এতটুকু চিন্তিত নই । তবে, এটুকুই শুধু আমি বলে যেতে চাই, তোমার স্বীকৃতির চেয়ে বড় উপহার হয়ত আমার কাছে আর কিছুই ছিল না মাম! 

 

 

                                                                                                                                       ইতি, 

                                                                                                                            তোমার অরণ্য

                                                                                                                                            ১৩/১২/২১

 

1 টি মন্তব্য:

সম্পাদকের কলমে

মাস আসে মাস যায়। বছর গড়ায় বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিরীহ মানুষ, হাভাতে মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থাকে তার নির্দিষ্ট ঘূর্ণি আবর্তে। পৃথিবীর...